সর্বজনীন পেনশন স্কিম সংক্রান্ত ‘বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন’ প্রত্যাহারের দাবিতে সর্বাত্মক কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষক সমিতি। এতে একাত্মতা ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহার না হলে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতৃবৃন্দ। 

সোমবার (১ জুলাই) ঢাবির কলা ভবনের সম্মুখ গেটে আয়োজিত অবস্থান কর্মসূচিতে নেতৃবৃন্দ এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এদিন সকাল থেকেই সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরতি নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

এর আগে গতকাল রোববার বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুল ইসলাম এবং মহাসচিব অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এই সর্বাত্মক কর্মবিরতির কথা জানানো হয়।

অবস্থান কর্মসূচিতে ঢাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, আধুনিক ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য, প্রধানমন্ত্রীর হাতকে শক্তিশালী করার জন্যই আমাদের এই আন্দোলন। এই আন্দোলন ততক্ষণ পর্যন্ত চলমান থাকবে যতক্ষণ না ঐ বৈষম্যমূলক প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহার না করা হবে। সেইসঙ্গে ২০১৫ সালে আমাদের যে সুপার গ্রেড দেওয়ার কথা ছিল সেটা চালু করতে হবে। আমাদের জন্য স্বতন্ত্র পে স্কেল চালু করতে হবে। বিভিন্ন আইন দিয়ে আমাদেরকে এসব দেওয়া হচ্ছে না এবং আমাদের দাবিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, আজকের এই সর্বাত্মক আন্দোলন শুধু আমাদের জন্য নয়, এটা শিক্ষার্থীদের জন্য, আগামী প্রজন্মের জন্য, শিক্ষাব্যবস্থার জন্য, প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য। তাহলে কারা বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার চালান যে এই আন্দোলনে শিক্ষার্থী ও শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষতি হবে? করোনার সময় দুই বছর পিছিয়ে গিয়েছিলো সেসব আমরা পুষিয়ে দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য সব আমরা করেছি। 

শিক্ষকদের পরিকল্পিতভাবে পাঠদান থেকে দমিয়ে রাখা হচ্ছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. জিনাত বলেন, আমরা বিদেশ থেকে টপ র‍্যাংকিং এ পিএইচডি করেছি। বিদেশের মোহ আমাদের দমাতে পারেনি। হ্যান্ডসাম এমাউন্টের চাকরিকে আমরা পদদলিত করেছি। কোনো  প্রলোভন, কোনো মোহ, কোনো চাকচিক্য তো আমাদের আকর্ষণ করে না। আমরা এই দেশকে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এবং শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে ভালোবাসি। আমরা গবেষণাগারে যেতে চাই, অনুসন্ধিৎসু মানসিকতাকে বিশ্লেষণ করতে চাই। কিন্তু আমাদেরকে দমিয়ে রাখা হচ্ছে, পাঠদানে মনোযোগী হতে দেওয়া হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষক সমাজ জ্ঞানী প্রজ্ঞাবান, নির্ভীক, নির্লোভ হওয়ায় সব স্বৈরাচাররা আমাদেরকে ভয় পায়, হোক সেটা সামরিক কিংবা বেসামরিক। কত টাকা বেতন-বোনাস পাই আমরা সেটা কখনো হিসাব করি না। তাহলে কোন হিসেবে আমাদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন? কোন হিসেবে আমাদের চাকরির বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৫৯ করার চিন্তা করেন? কোন হিসেবে আমাদের নমিনি নির্বাচনের ক্ষেত্র সংকুচিত করেন? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। নাহলে এই পেনশন স্কিম কখনোই সর্বজনীন হবে না।

ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে এই শিক্ষক নেতা বলেন, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে স্বৈরশাসনের সময় যখন প্রধানমন্ত্রীকে অবরুদ্ধ করা হয় সেদিন শিক্ষক সমাজ স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা, জরুরি অবস্থা ভেঙে আন্দোলন করেছিল। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, ৮২ হাজার শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়েছিল, রোকেয়া হলের ছাত্রীদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল। সেদিন শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলাম, আজও শিক্ষার্থীদের পাশে আমরা রয়েছি। আমরা কখনো পিছপা হইনি আজও হবো না। যতক্ষণ শিক্ষকরা তাদের কণ্ঠস্বর জ্বালিয়ে রাখবে ততক্ষণ বাংলাদেশ জেগে থাকবে। কোনো ষড়যন্ত্র, দুরভিসন্ধি বা প্রলোভন শিক্ষকদেরকে তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না।

ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, আমরা পূর্বঘোষিত কর্মসূচি হিসেবে আজ থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেছি। সারা দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এতে একাত্মতা ঘোষণা করে কর্মবিরতি শুরু করেছেন। আমাদের সরকারের কাছে ৩টি দাবি জানিয়েছি। বৈষম্যমূলক ও মর্যাদাহানিকর প্রত্যয় স্কিম থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনস্কেল প্রবর্তন, প্রতিশ্রুত সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালিত হবে।

প্রসঙ্গত, গত ২০ মে সর্বজনীন পেনশন স্কিম সংক্রান্ত ‘বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন’ প্রত্যাহার এবং পূর্বের পেনশন স্কিম চালু রাখার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। তার ধারাবাহিকতায় ২৬ মে বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে মানববন্ধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এরপর ২৮ মে দুই ঘণ্টা এবং ২৫-২৭ জুন তিনদিন সারা দেশে অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করা হয়। পরে গতকাল রোববার পূর্ণ কর্মবিরতি পালন করা হয় এবং আজ থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু হয়।

কেএইচ/এমএ