দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সব নাগরিককে সম্পৃক্ত করতে এবং সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছে সরকার। এরপর সর্বজনীন পেনশনে যোগ করা হয় ‘প্রত্যয়’ নামের একটি নতুন স্কিম। এতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ দেশের স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত সব প্রতিষ্ঠানের নতুন যোগ দেওয়া কর্মীদের বাধ্যতামূলক অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপরই বিষয়টিকে ন্যায়সংগত নয় উল্লেখ করে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন।

এরই অংশ হিসেবে প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহার, পূর্বের পেনশন স্কিম চালু রাখা, সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনস্কেল প্রবর্তন কার্যকর করার দাবিতে লাগাতার কর্মসূচি দিয়ে আসছে সংগঠনটি। এর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে কর্মবিরতি পালন করছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা। এতে করে এসব কর্মসূচির জাঁতাকলে পড়ে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়ে সেশনজটের শঙ্কায় পড়েছেন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা।

দেশে ২০২০ সালে করোনার প্রাদুর্ভাবের ফলে চরম ভোগান্তি ও ক্ষতির শিকার হয়েছিলেন সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরা। এতদিনে অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানোর কথা থাকলেও এখনো পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি তারা। এমতাবস্থায় আবারও শিক্ষকদের এই কর্মবিরতি দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিলে ফের সেশনজটের শঙ্কা করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। 

শিক্ষক নেতারা বলছেন, দাবি না মানলে আগামী ৩০ জুন আমরা পূর্ণ কর্মবিরতি এবং পরবর্তী সময়ে পয়লা জুলাই থেকে সর্বাত্মক কর্মসূচি শুরু করবেন তারা। দাবি আদায়ের আগ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে ক্লাস ও পরীক্ষা।

তাদের অভিযোগ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা নানান সমস্যায় ধুকলেও এসব বিষয়ে কখনো সরব হন না শিক্ষকরা। তবে, সরকারের একটা সিদ্ধান্ত তাদের নিজেদের স্বার্থে সরাসরি আঘাত হানতেই কর্মবিরতির মতো পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন তারা। 

অন্যদিকে, শিক্ষক নেতারা বলছেন, দাবি না মানলে আগামী ৩০ জুন আমরা পূর্ণ কর্মবিরতি এবং পরবর্তী সময়ে পয়লা জুলাই থেকে সর্বাত্মক কর্মসূচি শুরু করবেন তারা। দাবি আদায়ের আগ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে ক্লাস ও পরীক্ষা। অবশ্য, কর্মবিরতির ফলে সেশনজটের শঙ্কা তৈরি হলে পরবর্তী সময়ে অনলাইন ক্লাস বা ঘনঘন ক্লাস নেওয়ার মাধ্যমে সেটি রিকভার করা হবে বলে জানান তারা।

গত বছরের ১৭ আগস্ট প্রগতি, সমতা, প্রবাস ও সুরক্ষা— এই চার কর্মসূচি নিয়ে চালু হয় সর্বজনীন পেনশন স্কিম। পরে এতে প্রত্যয় স্কিম যুক্ত করা হয়। আগামী ১ জুলাই থেকে যা চালু হওয়ার কথা রয়েছে। স্কিমটিতে বাধ্যতামূলকভাবে যুক্ত হবেন রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত বা সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও সরকারি ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সব কমিশন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা–কর্মচারীরাও যুক্ত হবেন। 

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই কর্মবিরতির ফলে নিজেদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের ধারণা, সঠিক সময়ে পড়াশোনা শেষ না হলে চাকরির বাজারে চাকরিপ্রত্যাশীদের সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ার শঙ্কা তৈরি হবে।

মূলত এই প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহার এবং পূর্বের পেনশন স্কিম চালু রাখার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন শিক্ষক সমিতির নেতারা। দাবি আদায় না হলে সর্বাত্মক কর্মসূচিরও ঘোষণা দেন তারা। গত ২০ মে এসব দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। এরপর ২৬ মে বেলা সাড়ে ১১টায় সারা দেশের ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে মানববন্ধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। দু’দিন পর ২৮ মে দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করা হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার (২৫ জুন) থেকে বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) তিন দিন অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করছেন দেশের সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তবে, চলমান পরীক্ষাগুলো এই কর্মবিরতির আওতামুক্ত থাকবে বলে জানান তারা। 

এতেই শেষ নয়, এই তিনদিনের কর্মসূচির পরেও দাবি মেনে নিয়ে প্রত্যয় স্কিম বাতিল না করলে ৩০ জুন পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। সেদিনও যদি দাবি না মেনে নেওয়া হয়, তাহলে ১ জুলাই থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন তারা। এই সর্বাত্মক কর্মবিরতি চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের ক্লাস এবং পরীক্ষা স্থগিত থাকবে অনির্দিষ্টকালের জন্য। 

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই কর্মবিরতির ফলে নিজেদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের ধারণা, সঠিক সময়ে পড়াশোনা শেষ না হলে চাকরির বাজারে চাকরিপ্রত্যাশীদের সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ার শঙ্কা তৈরি হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী হেলালুর রহমান বলেন, দেশের এত সমস্যা চলছে, দুর্নীতির একরকম প্রতিযোগিতা চলছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা চতুর্মুখী সমস্যায় ধুকছে। এসব বিষয়ে শিক্ষক সমিতির কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। অথচ যখনই সরকারের একটা সিদ্ধান্ত তাদের স্বার্থে সরাসরি আঘাত করেছে, তখনি তারা কর্মবিরতির মতো পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। আর এই পদক্ষেপের কুফল ভোগ করতে পারে দেশসেরা মেধাবীদের। দীর্ঘস্থায়ী কর্মবিরতি হলে সেশনজটও হতে পারে। শিক্ষক একটা জাতির পথপ্রদর্শক। অথচ আমাদের দেশের শিক্ষকরা নিজেদের স্বার্থ সরাসরি জড়িত না থাকলে এই দেশ এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিন্দুমাত্র শঙ্কিত বোধ করেন না।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন বায়োসায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী শেখ সাদী ভূঁইয়া বলেন, পয়লা জুলাই থেকে পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে শুধু শিক্ষকরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একধরনের অচলাবস্থা বিরাজ করবে। আর এ আন্দোলন বছরের মাঝামাঝি সময় হওয়ায় শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি বেড়ে যাবে। এ সময়ে দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় টার্ম ও সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলে। ফলে সবচেয়ে বেশি সেশনজটের সমস্যায় পড়বে শিক্ষার্থীরা। এ অবস্থায় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত শিক্ষকদের সাথে কথা বলে বিষয়টির সুরাহা করা। 

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী পুলক খান বলেন, প্রত্যয় স্কিম বাতিল চেয়ে শিক্ষকদের কর্মবিরতির ফলে করোনা মহামারির পর আরও একটি বড় সেশন জটের দ্বারপ্রান্তে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। করোনার সময়ে যে সেশনজট হয়েছিল, তার ধকল এখনো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এতে দেখা যাচ্ছে যে, যারা এক বছর আগে বের হয়ে পুরোদমে চাকরির প্রস্তুতি নেওয়ার কথা, তারা এখন এক বছর পিছিয়ে আছে। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। কারণ জটে পড়লে অ্যাকাডেমিক পড়া শেষ না হওয়ায় চাকরির বয়স কমে যাব। ফলে শিক্ষকরা আন্দোলন করলে প্রভাব পড়বে শিক্ষার্থীদের ওপর।

এদিকে, নিজেদের দাবির বিষয়ে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব এবং ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া। তিনি বলেন, আমরা আজ, আগামীকাল ও পরশুদিন অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করবো। এর মাঝে আমাদের দাবি মেনে নেওয়া না হলে আগামী ৩০ জুন আমরা পূর্ণ কর্মবিরতি শুরু করব। এক্ষেত্রে পরীক্ষা কর্মবিরতির আওতামুক্ত থাকবে। এরপরও যদি আমাদের দাবি না মানা হয়, তাহলে ১ জুলাই থেকে সর্বাত্মক কর্মসূচি শুরু হবে। সেদিন থেকে কোনো ক্লাস চলবে না, পরীক্ষাও বন্ধ থাকবে দাবি আদায়ের আগ পর্যন্ত।

এই কর্মবিরতি শিক্ষার্থীদের সেশনজটে পড়ার শঙ্কায় ফেলছে কি না? এ প্রশ্নের জবাবে এই শিক্ষক নেতা বলেন, আমাদের কর্মবিরতির ফলে যদি সেশনজটের শঙ্কা তৈরি হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে আমরা অনলাইন ক্লাস বা ঘনঘন ক্লাস নেওয়ার মাধ্যমে সময় কমিয়ে সেটি রিকভার করব। প্রয়োজনে শুক্রবার ও শনিবারেও স্পেশাল ক্লাস দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীরা তাদের সেশনজট কমাতে আমাদের সাহায্য করবে বলে আমি মনে করি।

এ বিষয়ে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, কর্মবিরতি দীর্ঘস্থায়ী হবে না কি অল্প দিনের হবে সেটি এখনো বলা যাচ্ছে না। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট হবে কি না সেটি নির্ভর করবে কর্মবিরতির স্থায়ীত্বের ওপর। এখন এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। 

কেএইচ/কেএ