যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন বিরোধী শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন মুভমেন্টে’ এ একাত্মতা পোষণ কর্মসূচি পালন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর কুশপুতুল দাহ করেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।

রোববার (৫ মে) বিকেল ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এ কর্মসূচি পালিত হয়। পরে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ র‍্যালি নিয়ে শাহবাগ মোড় থেকে পুনরায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ইসলায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর কুশপুতুল দাহ করে সমাবেশ সমাপ্ত করেন। 

এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সী, প্যালেস্টাইন উইল বি ফ্রি’; ‘ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর, অকোপেশান মোর’; ‘ফাইভ, সিক্স, সেভেন, এইট, ইসরায়েল টেরোরিস্ট’; ‘ইসরায়েলের দোসররা, হুঁশিয়ার সাবধান’ ফ্রি ফ্রি প্যালেস্টাইন- ইত্যাদি স্লোগান দেন এবং  বিশ্বজুড়ে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে, মানবতার পক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

সমাবেশে ফিলিস্তিনি মানুষ ও আন্দোলরত শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি জানিয়ে ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে’ ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গান পরিবেশন করেন সংগীত বিভাগের শিক্ষার্থী আহমেদ আবদুল্লাহ সালমান ও তার বন্ধুরা, কবিতা পাঠ করেন ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ শাহীন ও আবিদ হাসান রাফি।

আইন বিভাগের শিক্ষার্থী শাখাওয়াত জাকারিয়া বলেন, আজকের এই সংহতি সমাবেশে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি জানান দেয় যে, বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ফিলিস্তিনের মানুষের জন্য কতটা মর্মাহত। এ পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় ফিলিস্তিনের ৩৪ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অক্টোবর থেকে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম চলছে, সারা বিশ্বের মানুষ তাদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছে, ইসরায়েলের বিরোধিতা করছে। এটা শুধু ফিলিস্তিনের পক্ষের লড়াই নয় বরং এটা সারা বিশ্বের আর্ত মানবতার জন্য লড়াই।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের পাসপোর্টে কিছুদিন আগেও ‘এক্সেপ্ট ইসরায়েল’ শব্দ উল্লেখ ছিল কিন্তু সেটা এখন তুলে দেওয়া হয়েছে। আমরা চাই আমাদের পাসপোর্টে আবার ‘এক্সেপ্ট ইসরায়েল’ শব্দটি যুক্ত করা হয়। আমরা জানতে পেরেছি, ইসরায়েলের কোম্পানি থেকে গোপন স্পাইওয়ার কেনা হয়েছে। আমরা বলতে চাই, এমন আবারও হলে সাধারণ মানুষ এর প্রতিবাদ করবে। যারা ইসসরায়েলকে সাহায্য করবে আমরা তাদের বয়কট করব। আমরা আশা করি ফিলিস্তিন একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, তারা তাদের স্বাধীনতা ফেরত পাবে।

সংহতি সমাবেশে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী এ বি জোবায়ের বলেন, ওই জায়নবাদরা যারা নিজেদেরকে সবসময় মানবতার পক্ষে দাবি করে কিন্তু তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবতাবিরোধী। তাদের কখনো লাশের ক্ষুধা মিটে না। তাদের ঘৃণ্য কাজের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বেই আন্দোলন করে আসছে। তাদের এসব কাজের বিরুদ্ধে যখন আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছিল তখন তাদের ওপর আমেরিকা সরকার পেটুয়া বাহিনী লেলিয়ে গ্রেপ্তার ও হেনস্তা করে। এমনকি তাদের অনেককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারও করা হয়।

তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শিক্ষার্থীরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে আসছে। এই ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের নামের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, তারা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জায়নবাদের দোসরদের মুখে থুতু নিক্ষেপ করি। আমরা চাই অতি দ্রুত এই ফিলিস্তিনি মানুষের ওপর বর্বরোচিত হামলা সমাপ্ত হোক এবং এর সঙ্গে জড়িতদের বিচার করা হোক। আমরা বিশ্ব শান্তি চাই। আমরা এমন বর্বরোচিত হামলা দেখতে চাই না।

ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী মিফতাহুল জান্নাত বলেন, এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ৩৪ হাজারের বেশি সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে। যারা নিরীহ, যাদের কোনো অপরাধ নেই। এখন পর্যন্ত গাজায় ১০ হাজারেরও বেশি নারী মারা গেছেন। গাজায় ৩৭টি হাসপাতালের মধ্যে ৩০টি হাসপাতালকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। গাজার ৮৭ শতাংশ স্কুলকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামী ২ বছর ধ্বংস্তূপ থেকে লাশ খুঁজে বের করলেও তা শেষ হবে না। সেখানে ১ লাখ ৫৫ হাজার গর্ভবতী নারী বেঁচে থাকার অধিকার পাচ্ছে না, এমনকি সুপেয় পানিও পাচ্ছে না। তারা তাদের সন্তান জন্মদান করতে পারছে না। এই নিরীহ মানুষের ওপর বর্বরোচিত হামলার আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাই।

আইন বিভাগের শিক্ষক নকিব নাসরুল্লাহ বলেন, শিক্ষার্থীরা মানবতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যে আয়োজন করেছে আমি এটাকে সমর্থন জানাতে এসেছি। আজকে আমাদের অবস্থান নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। ফিলিস্তিনকে সমর্থন জানাতে মুসলিম হওয়ার প্রয়োজন নেই, একজন মানুষ হলেই যথেষ্ট। এমন গণহত্যা বিশ্বের সব ইতিহাসকে ভেঙে দিয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কোন যুদ্ধে এত নারী-শিশু এর আগে কখনও হত্যা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, নেতানিয়াহু এবং এই যুদ্ধের সরাসরি মদদদাতা বাইডেন যুদ্ধাপরাধী। আমরা আমেরিকার মানুষের বিরুদ্ধে না। কিন্তু আমরা বলতে চাই, ‘নেতানিয়াহু ইজ অ্যা ওয়ার ক্রিমিনাল, বাইডেন ইজ অ্যা ওয়ার ক্রিমিনাল’। ফিলিস্তিনের পক্ষে পুরো বিশ্বে আন্দোলন যে শুরু হয়েছে, বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলেনে শরিক হওয়া উচিত। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের সব চক্রান্ত শেষ হবে বলে আমি মনে করি।

সমাবেশে ঢাবির ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক আরিফুল ইসলাম অপু বলেন, আমাদের নতুন করে কিছু বলার নেই। আমাদের এই আন্দোলন কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য নয়। এই আন্দোলন মানবতার বিরুদ্ধে বিষফোড়া ওইসব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এত পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তথ্যপ্রমাণবহুল গণহত্যা এর আগে বিশ্ববাসী কখনও দেখেনি। এই পরিমাণে তথ্যপ্রমাণসহ গণহত্যা দেখার পরেও বিশ্বের মোড়লরা তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। ফলে এই ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন তুলতে হবে। 

এ সময় তিনি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।

সমাবেশে বক্তব্য প্রদান করেন ঢাবি শিক্ষার্থী জয়েন উদ্দিন তন্ময়, শেখ তাওহিদ, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী মিশকাতুল জান্নাত, বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মুসাদ্দেক আলী ইবনে মোহাম্মদ প্রমুখ। 

এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত থেকে ফিলিস্তিনি মানুষও ও আন্দোলনরত আমেরিকার শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। 

কেএইচ/এমএ