প্রতিদিন ‘সালাম’ চান ঢাবি সাধারণ সম্পাদক!
এই গরমেও ছাত্রলীগের ‘প্রোগ্রাম বিলাস’, অসুস্থ হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা
দাবদাহে ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষ চরম অস্বস্তিতে রয়েছেন। রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠেছে। সারা দেশে কয়েক দফায় হিট অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
অতি তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে গত ২১ এপ্রিল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য সরাসরি পাঠদান বন্ধ করে অনলাইন ক্লাস শুরু করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দিনের বেলায় কোনো কর্মসূচি পালনের অনুমতি দিচ্ছে না প্রশাসন।
বিজ্ঞাপন
এমন পরিস্থিতির মধ্যেও গেস্টরুম কর্মসূচি ও প্রটোকল কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। তাদের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে তিন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের মৌলিক কোনো প্রোগ্রাম না থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত শীর্ষনেতাদের ‘প্রটোকল’ দিতে তীব্র গরমের মধ্যে ছুটতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন, টিএসসি বা ডাস চত্বরে প্রতিদিন শীর্ষনেতাদের সালাম দিতে যান বিভিন্ন হলের পদপ্রত্যাশী নেতারা। তারা হলের ১ম ও ২য় বর্ষের ছাত্রদের জোর করে তাদের সঙ্গে নিয়ে যান।
আরও পড়ুন
এদিকে, সপ্তাহে অন্তত তিন রাত বাধ্যতামূলক গেস্টরুম কর্মসূচিতে অংশ নিতে হচ্ছে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের। দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা তাদের গেস্টরুমে ম্যানার (আচার-আচরণ) শেখানোর নামে মানসিক ‘নির্যাতন’ করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কয়েকদিন আগে গেস্টরুম কর্মসূচিতে গিয়ে গরম সহ্য করতে না পেরে বিজয় একাত্তর হলের দুই শিক্ষার্থী জ্ঞান হারান।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কোনো শিক্ষার্থী যদি ছাত্রলীগের বাধ্যতামূলক প্রাত্যহিক কর্মসূচিতে যোগ না দেন বা গেস্টরুম কর্মসূচিতে অংশ না নেন তাহলে তাকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হয়। শাস্তির অংশ হিসেবে অকথ্য ভাষায় গালিগালাাজ করা হয় এবং কখনো কখনো গায়ে হাত তোলা হয়। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে।
গত মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) রাত ১০টার দিকে বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগের গেস্টরুম কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে অচেতন হয়ে পড়েন নিয়ামুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের ২০২২-২৩ সেশনের ছাত্র। তখন গেস্টরুম কর্মসূচির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাব্বি আহম্মেদের কর্মীরা। রাব্বি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের অনুসারী।
এর আগের দিন সোমবার একই হল ও বিভাগের মোহাম্মদ আলি শহীদ নামে অপর এক শিক্ষার্থী অচেতন হয়ে পড়েন। রাত ২টার দিকে তাকে এবং তার বন্ধুদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিয়মিত কেন অংশ নিচ্ছে না সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। অসহ্য গরম ও মানসিক চাপে একপর্যায়ে ওই শিক্ষার্থী অচেতন হয়ে পড়েন।
সৈকত বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি হল এবং বিভিন্ন অনুষদের সমন্বয়ে সাপ্তাহিক রুটিন তৈরি করে দেন। প্রতিদিন তিনি তার নেতাকর্মীদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাসে বসেন। রুটিন অনুযায়ী শুক্রবার বাদে সপ্তাহে ছয় দিন গড়ে তিনটি হল থেকে নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কোনো কর্মসূচি থাকুক বা না থাকুক সৈকত সেখানে বসেন এবং তার অনুসারীরা মিছিল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন।
এ দুই ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের চাপে রাখতে গত শুক্রবার রাতে বিজয় একাত্তর হলের গেস্টরুমে ফের তাদের ডাকা হয়। এসময় কয়েকজন সিনিয়রের হাতে স্টাম্প দেখা যায়। বিষয়টি সাংবাদিকরা জানতে পেরে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আবদুল বাসিরকে অবহিত করেন। যদিও পরে ছাত্রলীগ নেতারা বিষয়টি অস্বীকার করেন এবং অন্য কর্মীরা দ্রুত গেস্টরুম কর্মসূচির ইতি টানেন।
আরও পড়ুন
এদিকে, গত ২৭ এপ্রিল রাতে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে প্রচণ্ড গরমে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন কুয়েত-মৈত্রী হলের এক নারী শিক্ষার্থী। তাৎক্ষণিক তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি হল ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী নেত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারী সুমাইয়া জান্নাত সারার সঙ্গে ওই কর্মসূচিতে অংশ নিতে যান।
জানা গেছে, বিজয় একাত্তর হলের গেস্টরুমে অসুস্থ হয়ে পড়া দুই শিক্ষার্থীর একজনও সৈকতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তীব্র গরমের মধ্যে এখন একমাত্র তানভির হাসান সৈকতই হলের নেতাকর্মীদের দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এসব কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করছেন।
তারা বলছেন, দাবদাহের মধ্যে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সশরীরে ক্লাস নেওয়া বাতিল করে দিয়েছে সেখানে ছাত্রলীগের এসব কর্মসূচিতে বাধ্যতামূলক অংশ নেওয়া অমানবিক। অন্য কোনো নেতাকে এই গরমে কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায় না। শুধু তানভীর হাসান সৈকত এগুলো করছেন। অনেকে আড়ালে আবডালে তাকে মানবিক ছাত্রলীগের ‘অমানবিক সৈকত’ বলে তিরস্কার করছেন।
ঢাবি ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, সৈকত বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি হল এবং বিভিন্ন অনুষদের সমন্বয়ে সাপ্তাহিক রুটিন তৈরি করে দেন। প্রতিদিন তিনি তার নেতাকর্মীদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাসে বসেন। রুটিন অনুযায়ী শুক্রবার বাদে সপ্তাহে ছয় দিন গড়ে তিনটি হল থেকে নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কোনো কর্মসূচি থাকুক বা না থাকুক সৈকত সেখানে বসেন এবং তার অনুসারীরা মিছিল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন।
সৈকতের রুটিন অনুযায়ী, শনিবার জগন্নাথ, কুয়েত মৈত্রী ও শহীদুল্লাহ হল; রোববার শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা ও মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল; সোমবারে মুহসীন, সুফিয়া কামাল ও বঙ্গবন্ধু হল; মঙ্গলবার জসীম উদ্দিন, রোকেয়া ও অমর একুশে হল; বুধবার ফজলুল হক, শামছুন নাহার ও বিজয় একাত্তর হল এবং বৃহস্পতিবার সূর্যসেন, এ এফ রহমান হল ও বিভিন্ন অনুষদের নেতাকর্মীরা বাধ্যতামূলক কর্মসূচিতে উপস্থিত হন।
সৈকতের কর্মসূচিতে অংশ নিতে এসে শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ার পর ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম রবি ছাত্রলীগের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একটি ঘোষণা দেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আগামীকাল থেকে ডাসের প্রোগ্রাম বন্ধ থাকবে।’
এই গরমের মধ্যে গেস্টরুম বা প্রাত্যহিক প্রটোকল কর্মসূচির বিষয়ে জানতে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার কল দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ দুরন্ত, দুর্বার। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত- যেকোনো ঋতুতে ছাত্রলীগ তাদের কর্মসূচি পালন করে। ছাত্রলীগ হলো শিক্ষার্থীদের সংগঠন। সুতরাং শিক্ষার্থীদের ভালো-মন্দ বিবেচনা করেই দলীয় কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।’
সম্প্রতি ছাত্রলীগের মৌলিক কোনো কর্মসূচি না থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের ডাস চত্বরে উপস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে জানি না। গরমের মধ্যেও নিয়মিত কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে এটা আমার জানা নেই। বিষয়টি আমাকে জানতে হবে। তারপর কথা বলব’
কেএইচ/এমএআর/