বুয়েটে রাজনীতি নিয়ে যেসব প্রতিশ্রুতি দিলো ছাত্রলীগ
বুয়েটের রাজনীতি ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ, সেশনজট, র্যাগিং-বুলিং দখল-বাণিজ্য, হত্যা-সন্ত্রাসের ছাত্র রাজনীতি নয়। এই ছাত্র রাজনীতি হবে— আধুনিক, যুগোপযোগী, বৈচিত্র্যময়, সৃষ্টিশীল, যুক্তি-তথ্য ও তত্ত্বনির্ভর।
মঙ্গলবার (২ মার্চ) দুপুর পৌনে ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির আঁতুড়ঘর খ্যাত মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন।
বিজ্ঞাপন
সংবাদ সম্মেলনে বুয়েটে আধুনিক, স্মার্ট ও পলিসিনির্ভর নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাত্রলীগ ৪টি কর্মসূচি গ্রহণ করে। তা হলো-
১. ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম রাব্বীর আবাসিক হল ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বুয়েট শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি।
২. আধুনিক, স্মার্ট, পলিসিনির্ভর নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠার কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে বুয়েট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতামত বিনিময় ও আলোচনার আহ্বান।
৩. সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী-জঙ্গি কালোছায়া থেকে বুয়েটকে মুক্ত করতে সেমিনার ও সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজন।
৪. বুয়েটে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি পুনরায় শুরু হবে। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে আজকের দিনটি একটি ঐতিহাসিক দিন। কিন্তু এই রাজনীতি অবশ্যই ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ, সেশনজট, র্যাগিং-বুলিং, দখল-বাণিজ্য, হত্যা-সন্ত্রাসের ছাত্র রাজনীতি নয়। এই ছাত্র রাজনীতি হবে আধুনিক, যুগোপযোগী, বৈচিত্র্যময়-সৃষ্টিশীল, জ্ঞান-যুক্তি-তথ্য-তত্ত্বনির্ভর। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে এবং বিশ্বের সর্বোচ্চ র্যাংকিংধারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি কীভাবে পরিচালনা হয় তা থেকে জ্ঞান নিয়ে, নিজেদের চর্চায় সেটি নিয়ে বুয়েট আমাদের ছাত্ররাজনীতিকে পথ নির্দেশ করবে।’
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থীরা আগামী দিনে দেশের বৃহৎ সেক্টরে কাজ করবে উল্লেখ করে বলা হয়, ‘মহাকাশে কীভাবে অভিযান পরিচালনা করা যায়, রোবোটিক্সের মাধ্যমে কীভাবে শিল্পবিপ্লব জয় করা যায়, নিজ দেশের উচ্চ প্রশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ারদের মাধ্যমে কীভাবে পদ্মা সেতুর মতো বড় বড় সেতু নির্মাণ করা যায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করা যায়, আধুনিক যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের মাধ্যমে কীভাবে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় ভূভাগ ও সমুদ্রে কীভাবে অনুসন্ধান করা যায়, দেশের আমদানি কমিয়ে কীভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করা যায়, কোন পদ্ধতিতে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি করে বেকারত্বকে চিরতরে ঘুচিয়ে দেওয়া যায় এসব বিষয় নিয়ে কাজ করবে আগামী দিনে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থীরা।’
আরও পড়ুন
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের দেশ গঠনে ঝাঁপিয়ে পরতে নৈতিকভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করবে উল্লেখ করে বলা হয়, ‘প্রথাগত ছাত্র রাজনীতিতে কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেয়া নেতৃত্বের মাধ্যমে বুয়েট শিক্ষার্থীরা পরিচালিত হবে না। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের নেতৃত্ব নির্বাচন করবে। যে নেতৃত্ব হবে আদর্শিক, দেশাত্মবোধসম্পন্ন এবং যে নেতৃত্ব বুয়েটের শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকেই তৈরি করবে বিশ্বসেরা উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা। বুয়েটে আগামী দিনে এমন ছাত্র রাজনীতি পরিচালিত হবে যা প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বুয়েট শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার নামে ব্রেইন ডেইন বন্ধ করবে। বুয়েটে এমন ছাত্র রাজনীতি পরিচালিত হবে যা শহিদ শাফী ইমাম রুমীর মতো বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ ত্যাগ করে দেশের জন্য হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করতে শেখাবে। কিংবা উচ্চশিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরে এসে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগে ঝাঁপিয়ে পরতে নৈতিকভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করবে।’
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ কখনো সমর্থন করেনি উল্লেখ করে বলা হয়, ‘আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করেছেন, আবরারের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, প্রশাসন বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অতীতেও সমর্থন করেনি, বর্তমানেও করে না। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বারংবার বলার চেষ্টা করেছে, বাংলাদেশের মহান সংবিধান ও বুয়েট আইন কোনটিই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের এই সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেয় না। বুয়েট পরিবারের অংশীজনদের আবেগ-অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আহ্বান জানিয়েছে- ‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন।’
নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের নামে সেখানে ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বিশ্ব মানবতাবিরোধী মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ তাদের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে খুঁটি গেড়ে বসেছে। বাঙালির মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্মরণ করতে বাধাদান করা হয়েছে। একইসঙ্গে একজন শিক্ষার্থীর সংবিধান সম্মত চলাফেরা, মতপ্রকাশ, সমাবেশ ও সংগঠন করার যে অধিকার তা চূড়ান্তভাবে খর্ব করা হয়েছে। বৈষম্যমূলক- হিংসাত্মক- বিভেদের সামাজিক পরিকাঠামো চালু করা হয়েছে। জোরপূর্বক মতবাদ চাপিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীল সত্তাকে হত্যা করার প্লট রচনা করা হয়েছে।’
ইমতিয়াজ রাব্বির সিট বাতিলে ছাত্রসমাজ ও গণতন্ত্রকামী মানুষ ফুঁসে উঠেছে উল্লেখ করে নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘তুচ্ছ কারণে অপ্রাসঙ্গিক ও জোরপূর্বক গত ২৯ মার্চ ছাত্ররাজনীতি বন্ধের নামে স্বৈরাচারী কায়দায় বুয়েট শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম রাব্বীর আবাসিক হলের সিট বাতিল করা হয় এবং তাকে বুয়েট থেকে স্থায়ী বহিষ্কারের দাবি উত্থাপন করা হয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আড়ালে লুকিয়ে পরিচয় গোপন করে রাখা নিষিদ্ধ ও আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠনের কর্মীদের এই অহেতুক দাবি বুয়েট প্রশাসন অবিবেচকের মতো মেলে নিলে প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে দেশের ছাত্রসমাজ ও রাজনীতি সচেতন গণতন্ত্রকামী মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের অবৈধ আদেশ হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করলে আদালত তা বাতিল করে দেয়। ফলে বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি পরিচালনা করতে আর কোনো বাধা নেই।’
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন, সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, ঢাকা মহানগর উত্তর সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ, সাধারণ সম্পাদক সাগর আহমেদ শামীম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সভাপতি রাজিবুল ইসলাম বাপ্পি, সাধারণ সম্পাদক সজল কুন্ডুসহ কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
কেএইচ/এমএ