বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতি ফেরানোর দাবি আদায়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে পাচ্ছে না ছাত্রলীগ। রোববার ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব জোরপূর্বক বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করার সময় শিক্ষার্থীদের কেউ তাদের স্বাগত জানাননি।

গত বুধবার রাতে বুয়েটে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রবেশকে ঘিরে আন্দোলন-পাল্টা আন্দোলনের পর রোববার প্রকাশ্যে নেতাকর্মীদের নিয়ে বুয়েটে প্রবেশ করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

এ সময় তাদের স্বাগত জানাতে বা সমর্থন জানাতে কোনো বুয়েট শিক্ষার্থী উপস্থিত হননি। এমনকি ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ প্রবেশের খবর পেয়ে বুয়েটের মূল ফটক এবং হলগুলোর প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

রোববার দুপুর আড়াইটার দিকে শতাধিক নেতাকর্মী নিয়ে বুয়েট শহীদ মিনারে ফুল দেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান। ফুল দিয়ে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে বুয়েট ত্যাগ করেন তারা। 

এ সময় বুয়েটের ছাত্র কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য ইমতিয়াজ রাহিম রাব্বি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন এবং সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতসহ বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীরা সাদ্দাম-ইনানের সঙ্গে ছিলেন।

সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেও ছাত্রলীগের অন্যান্য নেতাকর্মীরা আরও কিছুক্ষণ সেখানে ছিলেন এবং তারাও শহীদ মিনারে ফুল দেন। তবে এ সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কোনো স্লোগান দিতে দেখা যায়নি।

এরপর রোববার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, ‘নিরাপত্তাজনিত কারণে বুয়েট শিক্ষার্থীদের আজ (রোববার) ক্যাম্পাসে অবস্থান না নেওয়া মানে এই নয় যে, বুয়েট শিক্ষার্থীরা তাদের ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবি থেকে সরে এসেছে। এ দাবি বুয়েটের সকল ব্যাচের সকল শিক্ষার্থীর।’

তারা আরও বলেন, ‘আজ বুয়েটের ২০ ব্যাচের টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। কোনোরূপ অবস্থান-আন্দোলন বা বাধা ছাড়াই নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ১ জন বাদে সকল শিক্ষার্থী স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত ছিল। ১২১৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১২১৪ জনই পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। এছাড়া গতকাল ২২ ব্যাচের প্রথম টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাতেও কোনো শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেনি, অর্থাৎ শতভাগ অনুপস্থিত ছিল। এ থেকেই প্রমাণিত হয় শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত নৈতিক অবস্থান ক্যাম্পাসে পুনরায় ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে। এই অবস্থান কতটুকু সুদৃঢ় তাও সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।’

এ বিষয়ে রোববার রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বিশ্বাস করি বুয়েটের শিক্ষার্থীরা তাদের গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ চায়, তাদের সাংবিধানিক অধিকার ফেরত চায়, তাদের রাজনৈতিক অধিকার চর্চার সুযোগ চায়। সুতরাং তাদের এই যৌক্তিক চাওয়ায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সবসময়ই পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে। 

বুয়েটে প্রবেশের সময় শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে সাড়া না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা যখন বুয়েটে প্রবেশ করি তখন বুয়েটের প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা আমাদের সঙ্গে ছিল এবং তারা ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি ফেরাতে যথেষ্ট আগ্রহী।

এ বিষয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মন্তব্য জানতে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তারা কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। তারা বলছেন, আজ সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে যে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে, সেটাই তাদের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য। 

এদিকে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চাইলে বুয়েটে আবার ছাত্ররাজনীতি ফিরতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বুয়েট উপাচার্য। রোববার দুপুরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এই মন্তব্য করেন।

এর আগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সমাবেশে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ফেরানোর জন্য ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন।

তিনি বলেন, বুয়েট প্রশাসনের কাছে আমাদের আহ্বান থাকবে অনতিবিলম্বে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি চালু করতে হবে। যে নিয়ম আপনারা শুরু করেছেন সেটি কালাকানুন, সেটি কালো আইন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার কোনো আইন নেই। যদি থেকেও থাকে সেটি সংবিধান বিরোধী। আমরা আজ শহীদ মিনার থেকে বুয়েট প্রশাসনকে আল্টিমেটাম দিচ্ছি অনতিবিলম্বে ছাত্ররাজনীতি চালু করতে হবে। স্বল্প সময়ের মধ্যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। বুয়েট শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ হোসেন রাব্বির সিট ফিরিয়ে দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা জানি ছাত্র রাজনীতিতে নেগেটিভ এলিমেন্ট রয়েছে। তবে এটাকে সংস্কার করতে হবে আরও ভালো ছাত্ররাজনীতি দিয়ে। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে সংবিধান অবমাননা করা হয়, যাচ্ছেতাই ক্যাম্পাস কালচার তৈরি করে। অন্ধকার রাজনীতি চর্চা করবে মৌলবাদী ও স্বাধীনতার বিপক্ষের গোষ্ঠীরা। হিজবুত তাহরির শিক্ষার্থীদের অফিসিয়াল ইমেইলে মেইল পাঠায় খেলাফত প্রতিষ্ঠার, কম্পাসে কিউআর কোড লাগায় জঙ্গিবাদ চর্চার। আমরা চাই বুয়েটের শিক্ষার্থীরা আধুনিকায়ন করে স্মার্ট ছাত্ররাজনীতি উপহার দেবে। তারা তাকলাগানো প্রযুক্তি তৈরি করে বাংলাদেশকে গর্বিত করবে। আপনারা বলেন ছাত্ররাজনীতিতে র‍্যাগিং ও গেস্টরুম কালচার রয়েছে।  আপনারা শিক্ষার্থীরা আসুন, ছাত্ররাজনীতির স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করুন আমরা গণতান্ত্রিকভাবে তা অনুসরণ করব।

ছাত্রলীগের সমাবেশের পর ছাত্ররাজনীতি চালুর বিষয়ে বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘তখন (২০১৯ সালে আবরার ফাহাদ হত্যা) যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, সেই পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত (ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা) নেওয়া হয়েছিল। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেটা যদি পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে তাদের আবার উদ্যোগী হতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চাইলে বুয়েটে পুনরায় ছাত্ররাজনীতি ফিরতে পারে।’ 

প্রসঙ্গত, গত ২৮ মার্চ মধ্যরাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি, দপ্তর সম্পাদকসহ অনেক নেতাকর্মী বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বুয়েট শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ রাব্বি। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পর বুয়েটে এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে নতুন করে রাজনীতি শুরুর পাঁয়তারা হিসেবে দেখছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ পাঁয়তারা রুখে দিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। 

কেএইচ/এসকেডি