ইফতারের মাত্র ২০ মিনিট বাকি। এমন সময় এক শিক্ষার্থীকে দেখা গেল প্লেটে চিড়া ভেজাতে। জিজ্ঞেস করে জানা গেল— খরচ বাঁচাতে তিনি চিড়া-চিনি দিয়েই ইফতার করেন। মাঝেমধ্যে যোগ করেন একটা কলা। দৃশ্যটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের এক্সটেনশন ভবনের তিনতলার একটি কক্ষের।

শুধু একটি নয়, ইফতারের আগ মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে এই চিত্র অনেকটাই সাধারণ। 

ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে ঢাকা শহরে খাবার খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। সেখানে একজন শিক্ষার্থীও নিজের বাজেটকে কাটছাঁট করছেন। ইফতারে ফলমূল তো দূরের কথা সাধারণ ইফতারি কিনতেও হিমশিম খাচ্ছেন অনেকেই। ইফতারে খরচ বাড়ালে সাহরিতে কমাতে হচ্ছে, আবার সাহরিতে খরচ বাড়ালে রাতের খাবার বন্ধ করছেন অনেক শিক্ষার্থী। ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের অনেক শিক্ষার্থীই মসজিদে ও জেলা/উপজেলা সমিতির ইফতারে অংশ নিচ্ছেন। আবার সিনিয়র শিক্ষার্থীরা চক্ষুলজ্জা ও সময় সুযোগের অভাবে বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ না নিয়ে কক্ষেই ‘নামমাত্র’ ইফতার সারছেন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের বিভিন্ন হলের একাধিক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায়, রোজার মাসে ভালো মানের ইফতারের আশায় এবং নিজের পকেট খরচ বাঁচাতে তারা বিভিন্ন জেলা-উপজেলা সমিতির ইফতার মাহফিলে যান। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল জামে মসজিদ, কাটাবন জামে মসজিদ, আজিমপুর কবরস্থান মসজিদ, লালবাগ মসজিদসহ অন্যান্য মসজিদে প্রতিদিন ফ্রি ইফতার দেওয়ায় সেখানেও যান শিক্ষার্থীরা। এতে নিজের খরচ বাঁচার পাশাপাশি ভালো মানের ইফতার জোটে তাদের ভাগ্যে।

এছাড়া রমজান মাস এলেই দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে দাম বাড়ে ক্যান্টিন বা মেসের খাবারেও। এতে ইফতারসহ তিনবেলা পেট ভরে খেতে হিমশিম খান মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা। ইফতারে (একজনের হিসেবে) ছোলা ১০ টাকা, মুড়ি ১০ টাকা, পিয়াজু-চপ-বেগুনি ১৫ টাকা, বুন্দিয়া ১০ টাকা, স্যালাইন বা শরবত ১০ টাকা, খেজুর ২ পিস ৫ টাকাসহ মোট ৬০ টাকা খরচ হয়। কেউ অতিরিক্ত হিসেবে ফল কিনতে চাইলে পেয়ারা কমপক্ষে ২০ টাকা, ছোট সাইজের অর্ধেক আনারস ২০ টাকা, কলা এক পিস (ছোট) ৫ টাকা খরচ হয়। সে হিসেবে কেউ ফল কিনে ইফতার করতে চাইলে তার কমপক্ষে ৮০-১০০ টাকা খরচ হয়। 

তাছাড়া সাহরির খাবারে গরু ৮০ টাকা, মুরগী ৫৫-৬০ টাকা, রুই মাছ ৫৫-৬০ টাকা, পাঙাশ ৪৫-৫০ টাকা, চন্দন ইলিশ ৫০ টাকায় বিক্রি হয়। তাছাড়া রাতের খাবারে মুরগী ভাত ৪৫-৫০ টাকা, ডিম ৪০ টাকা, রুই মাছ ৪৫-৫০ টাকা, পাঙাশ ৩৫-৪০ টাকা, তেলাপিয়া ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি হয়। ফলে সাহরি ও ইফতারবাবদ মাঝারি মানের খাবার খেতে একজন শিক্ষার্থীকে ১০০-১২০ টাকা খরচ করতে হয়।

শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের দিনপ্রতি খাবারের বরাদ্দ থাকে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ টাকা। কিন্তু রোজার মাসে ইফতারের ৬০ টাকা বা ফলমূলসহ ৮০-১০০ টাকা এবং সাহরি ও রাতের খাবারের ১০০-১২০ টাকা যোগ করে একজন শিক্ষার্থীকে গুনতে হয় দিনে ১৮০-২২০ টাকা। যা একজন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। যে কারণে অনেক শিক্ষার্থীই রাতের খাবার খান না।

প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সালমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি ছয় মাসও হয়নি। এখনো কোনো টিউশনি পাইনি। বাসা থেকে খরচ নিতেও লজ্জা লাগে। তাই সবসময়ই খরচ বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করি। রোজার মাসে খরচ বেড়ে গেছে আরও। ফলমূল ছাড়া সাধারণ ইফতারি কিনতে ৫০-৬০ টাকা খরচ হয়ে যায়। একা একা খেলে কখনোই ফলমূল কেনা সম্ভব না। একসঙ্গে কয়েকজনের ইফতারে ফল কিনতে চাইলে জনপ্রতি ১০০ টাকা খরচ হয়ে যায় যা আমিসহ অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই আমরা ভালো ইফতার খেতে বিভিন্ন উপজেলা সংগঠনের ইফতারে যাই। আর যেদিন এসব প্রোগ্রাম থাকে না সেদিন মসজিদে চলে যাই।

একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৬-১৭ সেশনসহ সিনিয়র শিক্ষার্থীরা সবসময় চাকরির পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকেন। ফলে তারা টিউশনি করারও সময় পান না। তাছাড়া সিনিয়র হওয়ায় বাসা থেকে সেভাবে টাকা নিতে পারেন না। বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করায় ফরম তোলাবাবদ প্রতি মাসেই তাদের মোটা অঙ্কের টাকা খরচ হয়। এর ফলে তারা চাইলেও বাইরে গিয়ে ইফতার খেতে পারেন না। এজন্য প্রতিটি রুমের শিক্ষার্থীরা আলাদাভাবে ইফতার করেন। বেশিরভাগই ছোলা-মুড়ি-পিয়াজু-চপ-বুন্দিয়া দিয়ে ইফতার করেন। ফলমূল তো দূরের কথা, খেজুরের দাম বেশি থাকায় প্রতিদিন খেজুরও কিনে খেতে পারেন না এসব শিক্ষার্থীরা। তবে দামে কম হওয়ায় মাঝেমধ্যে বাইরে থেকে পেয়ারা ও আনারস কিনে আনেন শিক্ষার্থীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাস্টার্সে অধ্যয়নরত সূর্যসেন হলের শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিকে বিভিন্ন প্রোগ্রামে বা দাওয়াতে গিয়ে ইফতার করতে পারতাম। কিন্তু এখন চক্ষুলজ্জায় সেটা সম্ভব না। তাছাড়া চাকরির পড়া পড়েই সময় পাই না, বাইরে দাওয়াতে যাওয়াটাও কঠিন। ব্যাচ ইফতারসহ বিভিন্ন ইফতারে চাঁদার পরিমাণ বেশি হওয়ায় সেখানেও ইফতার করি না। এছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষার ফরম তোলায় অনেক খরচ হয়, বাসা থেকেও বেশি টাকা চাইতে লজ্জা লাগে। তাই এই রোজায় প্রায় প্রতিদিন রুমেই ইফতার করেছি। কোনোদিন ছোলা-মুড়ি, কোনোদিন চিড়া-চিনি-কলা দিয়ে ইফতার করি। 

তিনি আরও বলেন, সাধারণত অন্যান্য মাসের দিনপ্রতি ১২০ টাকার মতো খরচ হয়। কিন্তু রমজান মাসে সবকিছুর দাম বাড়ায় ১২০ টাকায় হয় না। তাই মাঝেমধ্যে রাতের খাবারও খাই না। আবার মাঝেমধ্যে বাইরের দোকান থেকে ডিম বা মুরগী ছাড়া শুধু খিচুড়ি খাই।

দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাসেল বলেন, আমি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থী। পরিবার টানাপোড়েনের মধ্যে চলে। এমনিতেই মাসের শেষ দিকে পকেট খালি হয়ে যায়। রোজার মাসে সেটা আরও খারাপ অবস্থা হয়। খাবারের যা দাম, রুমে ইফতার করলেই ৫০-৬০ টাকা চলে যায়। আবার সাহরি বা রাতের খাবার তো আছেই। অন্যান্য মাসে যেখানে দিনপ্রতি ১০০-১২০ টাকা খরচ হয় সেখানে রোজায় ইফতার ও সেহরি খেতেই এর চেয়ে বেশি খরচ হয়। রাতের খাবার খেলে তো মাঝেমধ্যে ২০০ টাকাও খরচ হয়ে যায়। তাই চেষ্টা করি ইফতার অন্য কোথাও খেতে। মাঝেমধ্যে মসজিদে যাই বা বন্ধুদের জেলা বা উপজেলা সমিতির ইফতারে যাই। আবার কাটাবন মসজিদে ইফতার করি।

তিনি বলেন, যেদিন রুমে ইফতার করি সেদিন রাতে ক্ষুধা লাগে, তাই খেতে হয়। তবে বাইরে কোনো দাওয়াতে গেলে সেখানে ভালো খাবার পাওয়া যায়। সেদিন আর রাতে খাই না। একবারে সেহরিতে খেয়ে নেই। প্রতিদিন তিনবেলা খাওয়াটা প্রায় অসম্ভব আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য।

খাবার খরচ কমাতে এবং পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করতে হল প্রশাসনের সাহায্য চান এসব শিক্ষার্থীরা। হলের খাবারে ভর্তুকি প্রদান, বাকি ও ‘ফাও’ খাওয়া রোধ করার দাবিও জানান তারা।

রাসেল বলেন, হলের অনেক নেতা ক্যান্টিনে ফাও খান। ফলে ভুগতে হয় আমাদের মতো দরিদ্র শিক্ষার্থীদের। হল বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত খাবারে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা, না হলে শিক্ষার্থীরা তিনবেলা না খেতে পেরেই অপুষ্টিতে ভুগবে যা পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটাবে।

জহুরুল হক হলের ক্যান্টিন মালিক হাবিব বলেন, রোজার মাসে সবকিছুর দাম বেড়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা শিক্ষার্থীরা অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। তাদের পক্ষে এত টাকা খরচ করে ভালো খাবার খাওয়া অনেক কঠিন। সাধারণ ইফতার কিনেই তাদের অনেক খরচ হয়ে যায়। তাই ইফতার খেয়ে রাতের খাবার খেতে চান না তারা।

তিনি বলেন, হল থেকে মেসে (ডাইনিং) ভর্তুকি দেওয়া হলেও ক্যান্টিনে কোনো ভর্তুকি দেওয়া হয় না। আমাদেরকে ভর্তুকি দেওয়া হলে আমি খাবারের দাম কিছুটা কমাতে পারতাম। তবুও আমি সবসময়ই চেষ্টা করি শিক্ষার্থীদের সাধ্যের মধ্যে দাম রেখে ভালো খাবার সরবরাহ করতে। 

জসীমউদ্দিন হলের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাসিম বলেন, হলের খাবারের দাম বেশি। এর কারণ হলো— অনেকেই বাকি খায় আবার অনেকেই খেয়ে টাকা দেন না। কিছু পাতি নেতারা খেয়ে টাকা না দিয়ে চলে যায়। ক্যান্টিন মালিকরা কিছু বলতে না পারায় তারাও খাবারে দাম বাড়ান বা দাম ঠিক রেখে খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দেন। এতে ভোগান্তিতে পড়ি আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা। প্রশাসনের উচিত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং খাবারে কিছুটা হলেও ভর্তুকি দেওয়া যেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শিক্ষার্থীরা তিনবেলা খেয়ে থাকতে পারে। 

শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আবদুর রহিম বলেন, হল থেকে প্রতিবছরের ন্যায় ডাইনিংয়ে অল্প পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া হয়। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় কোনো কমার্শিয়াল জায়গা না সেহেতু প্রতিটি ক্যান্টিনে ভর্তুকি দেওয়াটা কঠিন। আমাদের যে বাজেট, তাতে খাবারে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি বরাদ্দ দেয় তাহলে ক্যান্টিনগুলোতে ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব হবে। 

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল রউফ মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশের বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে, তাই হলের ক্যান্টিন ও মেসেও খাবারের দাম অনেকটা বেড়েছে। তবুও আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রতিটি হলেই অল্প ভর্তুকি দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমি আমার এস এম হলের ডাইনিংয়ে ভর্তুকি দিয়েছি। অন্যান্য হল প্রাধ্যক্ষরাও আমাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। আশা করি এতে শিক্ষার্থীদের সমস্যা কিছুটা নিরসন হবে। 

কেএইচ/এমজে