শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মহত্যার পর উত্তাল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে আন্দোলন করছেন নিহতের সহপাঠীরা। যদিও এমন নিপীড়নের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগেও জবির শিক্ষকদের বিরুদ্ধে একাধিকবার যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল। তখন প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েও বিচার পাননি ভুক্তভোগীরা। উল্টো একাডেমিক ক্যারিয়ার হুমকির মধ্যে পড়েছিল। তবে, অবন্তিকার মৃত্যুর পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। 

২০২৩ সালের ১ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের প্রভাষক আবু শাহেদ ইমনের বিরুদ্ধে এমন নিপীড়নের অভিযোগ তোলে রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করেন এক শিক্ষার্থী। সেই আবেদনে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আবেদনমূলক আচরণ তথা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন, ঘাড় ম্যাসেজ করানো, স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করা এবং জোরপূর্বক জড়িয়ে ধরার অভিযোগ আনেন ভুক্তভোগী। 

শিক্ষার্থীরা বলছেন, একটি বা দুটি নয়— এমন নিপীড়নের ঘটনা অসংখ্যবার ঘটছে। অনেক শিক্ষার্থী লোকলজ্জার ভয়ে কিংবা একাডেমিক ক্যারিয়ার বাঁচাতে নীরবে সহ্য করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ প্রতিবাদ করলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উল্টো হয়রানির মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। অবন্তিকার ঘটনাটি আবারও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আর বসে থাকার সময় নেই। এখনই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে আগামীতে এমন ঘটনা আরও ঘটবে 

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ বি এম মানিকের বিরুদ্ধে। ওই সময় এ ঘটনা তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। পাশাপাশি শিক্ষক মানিককে বিভাগের সব কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন গত ২৪ জানুয়ারি জমা দিয়েছে কমিটি। আগামী সিন্ডিকেট সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।  

শিক্ষার্থীরা বলছেন, একটি বা দুটি নয়— এমন নিপীড়নের ঘটনা অসংখ্যবার ঘটছে। অনেক শিক্ষার্থী লোকলজ্জার ভয়ে কিংবা একাডেমিক ক্যারিয়ার বাঁচাতে নীরবে সহ্য করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ প্রতিবাদ করলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উল্টো হয়রানির মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। অবন্তিকার ঘটনাটি আবারও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আর বসে থাকার সময় নেই। এখনই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে আগামীতে এমন ঘটনা আরও ঘটবে।

যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটা যেকোনো ধরনের যৌন নিপীড়নের অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত কিংবা দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশের জন্য একটি সেল রয়েছে। ২০১৯ সালের পর থেকে এ সেলে মাত্র তিনটি অভিযোগ জমা পড়েছে

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী বলেন, বিভাগের প্রধান আমার শিক্ষা-জীবনটা শেষ করে দিয়েছেন। আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিচার না পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারেও অবস্থান নিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের ক্ষমতার কাছে হেরে যাই। অবন্তিকার মৃত্যু আবারও প্রমাণ করল যে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা কতটা অনিরাপদ। 

নাট্যকলা বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া সোমা বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নের যতগুলো ঘটনা প্রকাশ্যে আসে তার অনেকগুলোই থেকে যায় অপ্রকাশ্যে। প্রকাশ্যে যতগুলো আসে সেগুলোরও সুষ্ঠু বিচার হয় না। বিচার না হওয়ায় ভুক্তভোগীকে মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে দিন পার করতে হয়। একটা পর্যায়ে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।  

যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটা যেকোনো ধরনের যৌন নিপীড়নের অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত কিংবা দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশের জন্য একটি সেল রয়েছে। ২০১৯ সালের পর থেকে এ সেলে মাত্র তিনটি অভিযোগ জমা পড়েছে।

 অবন্তিকার আত্মহত্যার প্ররোচনায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে মশাল মিছিল করেন জবির সাধারণ শিক্ষার্থীরা / ছবি : ঢাকা পোস্ট

অভিযোগ পাওয়ার পর তা নিষ্পত্তি করতে বিলম্ব হওয়ার কারণ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন সেলের আহ্বায়ক প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা ঢাকা পোস্টকে বলেন, চাইলেই তো এক কিংবা দুই দিনে তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব হয় না। একটি সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আমাদের নানা পারিপার্শ্বিকতা মোকাবিলা করতে হয়। তারপরও আমরা ইতোমধ্যে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশনের প্রভাষক আবু শাহেদ ইমনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করে রিপোর্ট প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করেছি। আমাদের কাজ শুধু তদন্ত করে রিপোর্ট দাখিল করা। কিন্তু আমাদের এখানে তো তেমন অভিযোগই আসে না।

কেন অভিযোগ আসছে না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অনেক শিক্ষার্থী জানেই না বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি সেল রয়েছে। এ ছাড়া, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যক্তিত্ব ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এখানে অভিযোগ দিচ্ছে না।‘

যৌন নিপীড়নের ঘটনায় ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ৮২তম সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক আব্দুল হালিম প্রামাণিককে শাস্তি দেয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শাস্তির মধ্যে ছিল- আট বছর পদোন্নতি বন্ধ, ১০ বছর প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকা এবং নিজ কোর্স ছাড়া পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো কাজ থেকে বিরত রাখা। 

জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি নাট্যকলা বিভাগের এক ছাত্রী ক্লাসে উপস্থিতির নম্বরের বিষয়ে কথা বলতে বিভাগীয় চেয়ারম্যান আব্দুল হালিম প্রামাণিকের কাছে গেলে তিনি তাকে কুপ্রস্তাব দেন। পরে তার বিরুদ্ধে উপাচার্য বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন ওই ছাত্রী। অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়। 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অবন্তিকা / ছবি : সংগৃহীত

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন, আমার ভাবতে লজ্জা করে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের এমন নৈতিক স্খলন কীভাবে হতে পারে? যারা এ ধরনের হিংস্র মনোভাব প্রকাশ করে তাদের বলব, আপনারা শিক্ষকতার মতো মহৎ পেশাকে আর কলুষিত করবেন না। আপনারা শিক্ষকতা ছেড়ে দিন।

এসব বিষয়ে অভিযুক্ত শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তারা কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী সিন্ডিকেট সদস্য ও কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. হোসনে আরা বেগম বলেন, বিগত দিনে নারী নিপীড়ন ও যৌন হয়রানির ঘটনায় তেমন কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির না থাকায় একের পর এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেই চলছে। যৌন নিপীড়নে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যে শাস্তি হয় তা গুরুদণ্ডের লঘু শাস্তির নামান্তর। যেটা আমরা চারুকলার ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যে শাস্তি হয়েছে সেদিকে তাকালেই বুঝতে পারি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন সেলে অভিযোগ না পড়ার পেছনে বিভাগকে দায়ী করেন এ শিক্ষক। কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘সেলে অভিযোগ আসতে হলে বিভাগের মাধ্যমে আসতে হয়। যখন কোনো ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বিভাগের কাছে অভিযোগ নিয়ে দ্বারস্থ হয় তখন বিভাগ সেটার প্রকৃত সমাধান না করে বিষয়টি নানাভাবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। এমনকি ওই শিক্ষার্থীকে নানাভাবে মানসিক হেনস্তাও করা হয়। তাই আমি বলতে চাই, কোনো শিক্ষার্থী যদি সেলে অভিযোগ দিতে চায়, সেক্ষেত্রে বিভাগকে মাধ্যম না রেখে সরাসরি সেলে অভিযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেটা হতে পারে অনলাইন বা সরাসরি।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, আমরা ইতোমধ্যে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছি। বিগত দিনে যতগুলো এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর তদন্ত হয়েছে কিন্তু বিচার বাকি, আর যেগুলোর তদন্ত চলমান, সেগুলো দ্রুত তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এমএল/এসকেডি