বছর তিনেক আগেই শতবর্ষ পার করেছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সময়ের প্রয়োজনে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অবকাঠামোতে করা হয়েছে নানা সংযোজন ও বিয়োজন। তবে ১৯৬৬ সালে ৫ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসেনি কোনো পরিবর্তন। দীর্ঘ ৫৮ বছর পেরিয়ে গেলেও মসজিদটির আধুনিকায়নে নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ।

২০১৮ সাল থেকে সরকারের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হলেও সেখানে ঠাঁই পায়নি ঢাবির সেন্ট্রাল মসজিদ। শুধু মাস্টারপ্ল্যানেই সীমাবদ্ধ এর উন্নয়ন পরিকল্পনা! এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মপ্রাণ শিক্ষার্থীদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মসজিদের মূল ফটক শুধু দুটো সাধারণ পিলার ও একটি লোহার গেট দ্বারা বেষ্টিত। মসজিদকে ঘিরে লোহার গ্রিলের বেড়া রয়েছে। তবে সেই বেড়া যে কেউ চাইলেই টপকে ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে। ভেতরে ঢুকতেই প্রাচীন আমলের সিঁড়ি চোখে পড়ে। তিন স্তরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই কিছু ব্যবহারের অনুপযুক্ত পা মোছার কার্পেট লক্ষ্য করা যায়। যেগুলোর অধিকাংশই ছেঁড়া ও ময়লা। মসজিদের বারান্দায় প্রবেশের জায়গায় কোনো কার্পেট নেই।

মসজিদটির ভেতরের অংশ মার্বেল পাথরের ঢালাই হলেও বাইরের প্রশস্ত বারান্দায় দেওয়া হয়েছে সিমেন্টের ঢালাই। বারান্দার ছাদ আবার টিনের। অথচ দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও এখন পাকা ছাদের পাশাপাশি টাইলস বসিয়ে মসজিদ নির্মাণ করা হয়।

মসজিদের উপরে ও পাশের দেয়ালের রঙ করা হয়েছে দীর্ঘদিন আগে। এতদিনে সে রং উঠে গেছে। কয়েকটি জায়গায় পলেস্তরা খসে গেছে এবং বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট ফাটল দেখা দিয়েছে। মসজিদের অজুখানা সংলগ্ন ভেন্টিলেটর সদৃশ দেয়ালের দিকে তাকালে মনে হয় কয়েক যুগ ধরে সেখানে কেউ পরিষ্কারের জন্য হাত লাগায়নি৷

বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল মসজিদ, ইন্টারন্যাশনাল হল মসজিদ, সিনেট মসজিদসহ বেশ কয়েকটি হলের মসজিদে এসি লাগানো রয়েছে। ঢাকা শহরের অলিতে-গলির যেকোনো মসজিদেও এখন এসি লাগানো হয়। কিন্তু দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল মসজিদটি অবহেলিত রয়ে গেছে। প্রাচীন আমলে লাগানো ফ্যান বা পাখা দিয়ে চলছে বছরের পর বছর।

এদিকে মসজিদের ৫টি শৌচাগারের মধ্যে ২টি তালাবদ্ধ রয়েছে। এ দুটির একটি ইমাম মুয়াজ্জিনদের জন্য নির্ধারিত এবং বাকিটা সংস্কারের জন্য বন্ধ রয়েছে।

সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত বাকি ৩টি শৌচাগারও ব্যবহারের প্রায় অনুপযুক্ত। এগুলোর বাইরে ও ভেতরের পরিবেশ অত্যন্ত স্যাঁতসেঁতে। কাছে যেতেই উটকো গন্ধ নাকে লাগে। বাধ্য না হলে সাধারণত কেউ এই শৌচাগার ব্যবহার করেন না বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী।

শৌচাগার কেন এত অপরিষ্কার? এমন প্রশ্নের জবাবে মসজিদের ইমাম নাজির মাহমুদ বলেন, হাজার হাজার মানুষ এগুলো ব্যবহার করে। সুইপার দিনে একবার এসে পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। বেশি মানুষ ব্যবহার করায় কিছুটা অপরিষ্কার থাকে। দিনে দুবার পরিষ্কার করলে কিছুটা পরিচ্ছন্ন হবে।

এদিকে ওজু করার জন্য নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক পানির কল। যেগুলো আছে সেগুলোর মধ্যে ২টি নষ্ট। কলের মুখে ব্যবহৃত মেসওয়াকের কাঠি দিয়ে পানি আসার পথ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তাছাড়া ওজুর জন্য নির্ধারিত পানির ট্যাংকও স্বল্প পানি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন। ওজুর মাঝেই অনেক সময় পানি ফুরিয়ে যায়, ফলে মুসল্লিদের পানি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। উপায় না পেয়ে মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত ওযুখানায় অনেক ছেলে শিক্ষার্থীকে প্রবেশ করতে দেখা যায়।

মসজিদের ভেতরের ২১টি কাতারের মাঝে মাত্র ৫টি কাতার কার্পেটে মোড়ানো। কার্পেটের উপরের সাদা কাপড় দীর্ঘদিন পরিষ্কারের অভাবে ময়লা হয়ে পড়ে আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মসজিদের একজন খাদেম বলেন, মসজিদের দেয়ালগুলো আলো বাতাস প্রবেশের ভেন্টিলেটরের মতো ছোট ছোট ফাঁকযুক্ত হওয়ায় বাতাসের ঝাপটায় ভেতরে ধুলাবালি প্রবেশ করে। এছাড়া প্রস্রাবখানার দেয়াল ও মসজিদের দেয়াল অভিন্ন যা মসজিদের আদব বিরোধী।

তিনি বলেন, সুইপার দিনে একবার এসে মসজিদের শৌচাগার পরিষ্কার করে। সেটাও শুধু একটু বাড়ি দিয়ে চলে যায়। সপ্তাহে একবার দুর্গন্ধ দূর করতে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে যায়। এজন্য শৌচাগার স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় মসজিদে কুরআন-হাদিসসহ প্রায় ৩০০-৪০০ ইসলামিক বইয়ের লাইব্রেরি ছিল। এগুলো কাঠের আলমারিতে রাখার কারণে ২০০৫ সালের দিকে উইপোকা সব বই নষ্ট করে ফেলে। তারপর আর মসজিদে বইয়ের সংখ্যা বাড়ানো হয়নি। ফলে অল্পকিছু বই থাকলেও সেগুলো পড়ার অনুপযুক্ত। বর্তমানে বড় দুটি বইয়ের তাকে ৫০-৫৫টি কোরআন শরিফ ও মাত্র ৫-৬টি ইসলামিক বই আছে। বাকিটা সম্পূর্ণ খালি পড়ে রয়েছে।

এদিকে জুমার দিন মুসল্লিদের জায়গা না হওয়ায় মসজিদের বাইরেই নামাজ পড়েন কয়েকশ মুসল্লি। মসজিদের দক্ষিণ পাশে নারীদের জন্য নামাজের জায়গা থাকলেও সেটা খুব ছোট। সেখানে মাত্র ১৪-১৫ জন এক সঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। তবে নারীদের নামাজের জায়গার প্রবেশমুখেই আরেকটা ওজুখানা থাকায় সেখানে প্রবেশে তারা ইতস্তত বোধ করেন।

তবে সব সমস্যা ছাপিয়ে আলোচনায় রয়েছে বারবার চুরির ঘটনা। প্রায়ই মসজিদ থেকে মুসল্লিদের মোবাইল, ব্যাগ ও জুতা চুরি হয় সেখান থেকে। নামাজির বেশে চোর ভেতরে প্রবেশ করে সুযোগ মতো জুতা বা অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে পালিয়ে যায়। তাছাড়া কিছুদিন আগে এক ব্যক্তির মোটরসাইকেলও চুরি হয় মসজিদের সামনে থেকে। তবে চোরদের ধরার জন্য কারো চেষ্টা করা হয়নি মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে। মসজিদের প্রবেশপথে দুটি সিসিটিভি ক্যামেরা এবং ভেতরে আরও ৭-৮টি সিসিটিভি ক্যামেরা দেখা গেলেও সেগুলো দীর্ঘদিন ধরে অচল।

মসজিদে চুরি হওয়া এবং সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যাপারে ইমাম নাজীর মাহমুদ বলেন, মসজিদে একজন চোর এসে শুয়ে থাকে অন্যজন বাইরে অপেক্ষা করে। ভেতরের চোর ইশারা দিলে বাইরের চোর চুরি করে। এমনকি জানাজার নামাজ চলাকালেও মোবাইল ফোন চুরি হয়েছে। শিক্ষক সমিতির সভাপতি নিজামুল হক ভূঁইয়ার আইফোন চুরি করা হয়েছিল এ মসজিদ থেকে। তাছাড়া বাইরে রাখা মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে কিছুদিন আগেই।

তিনি বলেন, সিসিটিভি ক্যামেরা সবগুলোই নষ্ট। একটা কিছু নষ্ট হলে আমরা দ্রুতই কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে অবহিত করি। তবে সেটা সংস্কার হতে সময় লাগে। সিসিটিভির ব্যাপারেও আমরা জানিয়েছি কর্তৃপক্ষকে। কাজ চলছে, আশা করি দ্রুত সেগুলো নতুন করে বসানো হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তারিক বলেন, সরকার সারাদেশে ৫৬০টি মডেল মসজিদ বানালেও দেশ সেরা শিক্ষার্থীদের দিকে কারো নজর নেই! গ্রামের সাধারণ মসজিদও টাইলসের তৈরি হলেও ঢাবির সেন্ট্রাল মসজিদ সাধারণ মোজাইক করা। আর বারান্দা সিমেন্টের ঢালাই। হাস্যকর ব্যাপার হলো এত বড় বারান্দার ছাদটাও টিন-শেডের। মনে হয় বাজেটের টাকা শর্ট পড়ায় ঢালাইয়ের বদলে টিন দিয়ে কাজ শেষ করেছে কর্তৃপক্ষ। ওয়াশরুম তো ব্যবহারের অনুপযুক্ত। মনে হয় সপ্তাহে দুই-তিনদিন পরিষ্কার করা হয়, দুর্গন্ধ ছড়ায় চারদিকে।

আরেক শিক্ষার্থী মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, বছরের পর বছর ধরে সেন্ট্রাল মসজিদের কোনো সংস্কার কাজ হয় না। মসজিদে চোরের উৎপাত বেড়েছে। কিছুদিন আগে আমার মোবাইল ফোনসহ ব্যাগ চুরি হয়ে যায়। আমি সিসিটিভি দেখতে চাইলে বলা হয় ক্যামেরা নষ্ট। বাধ্য হয়েই মোবাইল ও ব্যাগ ফিরে পাবার আশা ছেড়ে দিয়েছি।

সার্বিক বিষয়ে কেন্দ্রীয় মসজিদের সিনিয়র ইমাম ও খতীব ড. সৈয়দ মুহাম্মদ এমদাদ উদ্দীন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মাস্টারপ্ল্যান প্রণীত হয়েছে সেখানে সেন্ট্রাল মসজিদ আধুনিকায়নের কথা বলা হয়েছে। প্রথম ধাপেই নকশার কাজ শেষ হয়ে গেছে। নকশা অনুযায়ী মসজিদটি হবে ৪ তলা বিশিষ্ট। মসজিদের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর অধিদপ্তরে জমা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারপ্ল্যানের কাজ শুরু হলে মসজিদের কাজও শুরু হয়ে যাবে।

সার্বিক বিষয়ে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, মসজিদের জন্য আলাদা কোনো ফান্ড নেই। মসজিদের ছোট ছোট সংস্কারকাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে নিয়ে করা হয়। তাছাড়া বড় ধরনের সংস্কারকাজে এখন বিশ্ববিদ্যালয় যাবে না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানের শুরুর দিকে রয়েছে সেন্ট্রাল মসজিদের আধুনিক নতুন ভবন নির্মাণ প্রকল্প। যখন মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন শুরু হবে প্রথম দিকেই মসজিদ ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হবে। তাছাড়া অন্যান্য ছোট ছোট সংস্কার কাজ যেমন, সিসিটিভি ক্যামেরা পুনঃস্থাপন, নতুন কার্পেট যুক্ত করাসহ অন্যান্য কাজগুলো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

উল্লেখ্য, ১৯৬৬ সালের ২০ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি ড. ওসমান গনি মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পবিত্র রমজান মাসের এক শুক্রবার উদ্বোধনের পর এখানে প্রথম মাগরিবের নামাজ আদায় করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩টি মসজিদের মধ্যে এটিই সেন্ট্রাল মসজিদ হিসেবে পরিচিত। মসজিদটির দুটি মিনার, কারুকার্যখচিত দরজা-জানালা, ৯টি ঝাড়বাতি ও দুটি বই রাখার আলমারি রয়েছে। মসজিদে একসঙ্গে প্রায় আড়াই হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান নামাজ আদায় করতে পারেন। 

কেএইচ/এসকেডি