ফলাফলে ধস নামানোর অভিযোগ ঢাবি অধ্যাপকের বিরুদ্ধে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একটি ব্যাচের ফলাফলে ধস নামানোর অভিযোগ উঠেছে ওই বিভাগের একজন অধ্যাপকের বিরুদ্ধে। বিভাগের ১২তম ব্যাচের স্নাতকোত্তর শ্রেণির চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের পর এমন অভিযোগ পাওয়া যায় ব্যাচটির পক্ষ থেকে। অভিযুক্ত ওই অধ্যাপকের নাম ড. নাদির জুনাইদ।
বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) ঘটনার প্রতিকার চেয়ে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নম্বর কমিয়ে দেওয়ার অভিযোগ এনে অধ্যাপকের নাম ড. নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।
বিজ্ঞাপন
লিখিত অভিযোগপত্রে শিক্ষার্থীরা ১২তম ব্যাচের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা ও অন্যান্য ক্লাসে রেজাল্ট প্রকাশের আগেই করা মন্তব্যের সবিস্তর বর্ণনা করেন এবং ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকেই অধ্যাপক নাদির এই কাজ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়।
এসময় অভিযোগকারীরা উপাচার্যের কাছে তিনটি দাবি জানিয়েছেন- সিন্ডিকেটের মাধ্যমে স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করে মৌখিক পরীক্ষা আবার নেওয়া ও সম্পূর্ণ ফলাফল পুনর্মূল্যায়ন, অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করা এবং শিক্ষক মূল্যায়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় যে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা দ্রুত চালু করা।
এ ঘটনায় বিভাগের অধ্যাপক নাদিরের বিরুদ্ধে ২৮ জন শিক্ষার্থীর স্বাক্ষর করা ওই অভিযোগপত্র গ্রহণ করে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য।
অভিযুক্ত শিক্ষকের ব্যক্তিগত অপশনাল কোর্সে কেউ আগ্রহী না হওয়ায় ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে তিনি ওই কাণ্ড ঘটান বলে দাবি সংশ্লিষ্ট ব্যাচের শিক্ষার্থীদের। অধ্যাপক নাদির জুনাইদের এমন কার্যক্রমে বিরক্ত ও হতাশা প্রকাশ করে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে নিয়ে পোস্ট করেন। এমন একটি পোস্টে ‘প্রতিক্রিয়া’ দেখানোকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি এক শিক্ষার্থীকে তার অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে বকাঝকা করেন তিনি।
তবে তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ ভিত্তিহীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে এর কারণ, আমি ক্লাসে তাদেরকে অনেক কড়াকড়া কথা বলি। বিভিন্ন ঘটনাকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে প্রকাশ করছে তারা। একজন শিক্ষক চাইলেই কোনো ব্যাচের রেজাল্ট খারাপ করতে পারে না। রেজাল্ট প্রকাশের পর যদি একজন শিক্ষার্থীও আমার কাছে এসে বলতো স্যার রেজাল্ট আশানুরূপ হয়নি, তাহলে আমি তাদের যৌক্তিক পরামর্শ দিতাম। কিন্তু তাদের কেউ আমার কাছে না এসে সংবাদমাধ্যমকে এসব বলছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের দাবি, স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় সেমিস্টারে ড. নাদিরের দুটি ‘অপশনাল কোর্স’ থাকলেও কোনো শিক্ষার্থী ওই কোর্সগুলো নিতে আগ্রহী হননি। এই ক্ষোভ থেকেই ওই শিক্ষক ফলাফলে ধস নামাতে পারেন বলে বলে ধারণা শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাস্টার্স দ্বিতীয় সেমিস্টারের কোর্সের সমন্বয়ক ছিলেন অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ। ফলে তিনি স্নাতকোত্তর পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও সমন্বিত কোর্সের পরীক্ষকও ছিলেন। ওই কোর্সটিতে ৫৪ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫ জনই এ ধরনের গ্রেডকে ‘নজিরবিহীন’ বলছেন। একই মন্তব্য ওই বিভাগের শিক্ষকদেরও। সিংহভাগ শিক্ষার্থীই পয়েন্ট ৪-এর স্কেলে ৩.০০ এর নিচে পেয়েছেন। এর মধ্যে ২.৫০ পেয়েছেন ১৪ জন, ২.২৫ পেয়েছেন ১২ জন, ২.০০ পেয়েছেন পাঁচজন। অন্যদিকে স্নাতক পর্যায়ের ফলাফলে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হওয়া প্রথম দশজনের ৬ জনের মধ্যে একজন পেয়েছেন ২.৭৫। অন্যরা পেয়েছেন ২.৭৫ এর নিচে।
চূড়ান্ত ভাইভায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা জানান, ভাইভাতে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে পরীক্ষার্থীদের অপ্রস্তুত ও ভীতসন্ত্রস্ত করে ফেলতেন অধ্যাপক নাদির। যেমন, ‘কুকুরের কয়েকটি জাতের নাম বলো।’
ভুক্তভোগী ওই ব্যাচের শিক্ষার্থী শাফাত রহমান এ নিয়ে ফেসবুকে লেখেন, তিনি (ড. নাদির জুনাইদ) ভাইভাতে আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘ইন্দিরা গান্ধীর সন্তান কতজন?’ আরেক শিক্ষার্থী ফেসবুকে লেখেন, তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন, ১৯৮৩ বিশ্বকাপে যার রেকর্ড ছিল, সেই খেলোয়াড়ের দেশের সঙ্গে কপিল দেব পরের বিশ্বকাপে দুইটা রেকর্ড করে। রেকর্ডগুলো কী কী?’
এসব অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের কারণে শিক্ষার্থীরা জানা প্রশ্নের উত্তর দিতেও গিয়ে ভড়কে যেতেন। এ ধরনের প্রশ্ন করে তিনি অন্য পরীক্ষকদের সামনে শিক্ষার্থীদের ‘ইম্প্রেশন’ খারাপ করে দেন। এর পাশাপাশি সার্বিক প্রতিফলন ঘটেছে সমন্বিত কোর্সের নম্বরেও।
বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমি ভাইভাতে ‘ইয়েস’ বলে তার একটা প্রশ্নের সাড়া দিয়েছিলাম। কেন তাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করিনি- এ নিয়ে অন্তত দশ মিনিট ধরে আমাকে বকাঝকা করেন। ফলে ভাইভার শুরুতেই আমি নার্ভাস হয়ে যাই। সব সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর শেষে তিনি আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন। তিনি আমাকে এত প্রশ্ন করতে শুরু করেন যে অন্য একজন শিক্ষক তাকে শেষ করার অনুরোধ করেন। এরপরও অন্তত ৫-৭টি প্রশ্ন করেন। স্বাভাবিকভাবে সেসময় তিনি এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন যে আমি জানা প্রশ্নের উত্তরও ভুল করছিলাম।
আরও পড়ুন
প্রকাশিত হওয়ার আগে ফলাফল নিয়ে মন্তব্য
ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মের পরিপন্থি। তবে, ১২তম ব্যাচের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগে তা নিয়ে অন্য একটি ব্যাচের ক্লাসে তিনি মন্তব্য করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যাচের এক শিক্ষার্থী জানান, কয়েকদিন আগে তিনি আমাদের ক্লাসে ১২তম ব্যাচের ফলাফল নিয়ে কথা বলেন। এসময় তিনি বলেন, ‘১২ ব্যাচের রেজাল্টটা দেখবা কী অবস্থা। কয়েকজন ফেল করতে করতে পাস করে গেছে।’ অথচ সেসময় ফলাফল প্রকাশিতই হয়নি।
একইভাবে ১৬তম ব্যাচের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগেই তিনি ওই ব্যাচের এক শিক্ষার্থীকে তার ফল বলে দেন। একই ব্যাচের অন্য এক শিক্ষার্থী জানান, চারটা নাগাদ আমাদের ব্যাচের ফলাফল নোটিশ বোর্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে টানানো হয়। তবে, ওই দিনই দুপুর দুইটার দিকেই ওই ব্যাচের শিক্ষার্থীকে অধ্যাপক নাদির জুনাইদ স্যার তার ফল বলে দেন।
একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের ফেসবুক কার্যক্রমেও নজরদারি করেন অধ্যাপক নাদির। শিক্ষার্থীরা বলেন, অধ্যাপক নাদির জুনাইদ শিক্ষার্থীদের ফেসবুক কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এর ভিত্তিতে তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করবেন, তা নির্ধারণ করেন। এমনকি, ফেসবুক কার্যক্রম দেখে পরীক্ষায় নম্বর দেওয়ার হুমকিও দেন তিনি। সম্প্রতি দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে এমন হুমকি দেন তিনি। বর্তমান শিক্ষার্থী হওয়ায় তিনিও নাম প্রকাশ করতে সাহস পাননি।
১২তম ব্যাচের ভুক্তভোগী এক নারী শিক্ষার্থী জানান, ভাইভা বোর্ডে তিনি আমার ফেসবুক কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন করেন। আমি বিভিন্ন সময় মজা করে অনেক পোস্ট করি। এ নিয়ে তিনি আমাকে বিব্রতকর কথা বলতে শুরু করেন। আমি ভাইভাতে কেঁদেও দিয়েছিলাম।
এদিকে ক্লাস চলাকালে ঘুরেফিরে ক্লাসে চলচ্চিত্র প্রসঙ্গ টানেন অধ্যাপক নাদির। যেকোনো কোর্সের ক্লাসেই চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। সংশ্লিষ্ট কোর্স নিয়ে দুই এক মিনিট কথা বলেই চলচ্চিত্রের আলোচনা শুরু করেন তিনি। প্রায় প্রতিটি ক্লাসেই একই ধরনের কথা বলেন।
বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের ব্যাচের সার্বিক ফলাফল ভালো। তিনি আমাদের ক্লাসে এসে বলেন, আমি যদি তোমাদের আরও কয়েকটি কোর্স নিতাম, তাহলে দেখতে তোমাদের রেজাল্ট কী হতো! তোমরা নাকি অনেক মেধাবী। দেখি তোমাদের মেধা কেমন। এমন কথা বলে তিনি বিভিন্ন চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা ও সংলাপের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা শুরু করেন। স্বাভাবিকভাবে অনেকেই উত্তর দিতে পারে না। এ নিয়ে পরে তিরস্কার করাও শুরু করেন তিনি।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. নাদির জুনায়েদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, একজন শিক্ষক একা কখনো একটি ব্যাচের সবার নাম্বার কমাতে পারে না। এক্সামের খাতা দুজন শিক্ষক মূল্যায়ন করেন। একজন কম দিলে অন্যজন বেশি নাম্বার দিলে নম্বরের পার্থক্য ১০ হলে তৃতীয় শিক্ষক খাতা মূল্যায়ন করেন। আবার ভাইভা বোর্ডে ৪ জন শিক্ষক থাকেন। একজন কম নাম্বার দিলেও বাকিরা বেশি দিলে গড়ে নাম্বার বেশি থাকবে এটা স্বাভাবিক।
১২তম ব্যাচের রেজাল্ট প্রকাশ করার এক মাস আগেই নিচের ব্যাচগুলোকে তাদের রেজাল্ট বলে দেন এমন অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘না, এমনটা আমি করিনি। আমি প্রতি ব্যাচকেই বলি তোমাদের কিন্তু রেজাল্ট ভালো হচ্ছে না। বিভিন্ন সেশনাল নাম্বার দেওয়ার পরে আমি তখন বলি, দেখ রেজাল্ট কমে গেল। এমন হলে তো ভালো রেজাল্ট হবে না। আমি এটাও বলি, তোমাদের সিনিয়রদের গত বছরও এই কোর্স পড়িয়েছি, তারা নিশ্চয়ই ভুলে গেছে। তারা কিন্তু খারাপ করছে। তোমরা কিন্তু এমন করো না।
ভাইভা বোর্ডে অযৌক্তিক প্রশ্ন সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা ভিত্তিহীন অভিযোগ। আমি ক্লাসে একটি কোর্সের এক টপিক পড়াতে গিয়ে ‘এক জাতের কুকুর দিয়ে ভেড়ার পাল নিয়ন্ত্রণে’র উদাহরণ দিয়েছিলাম। এটাই তারা অভিযোগ করছে।
ক্লাসে অভিনেতা-অভিনেত্রীর ছবি দেখান কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ক্লাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গেরিলাদের ছবি দেখিয়েছিলাম। তাছাড়া আমাদের দেশের বিখ্যাত অভিনেতার ছবি দেখিয়েছিলাম। কিন্তু তারা পারেনি বলে আমি বলেছি, তোমরা কত মডেলদের চেনো কিন্তু দেশের সূর্য সন্তানদের চেনো না, এটা দুঃখজনক।
ভাইভায় এক শিক্ষার্থীকে দীর্ঘক্ষণ বকাবকি করার বিষয়ে তিনি বলেন, ভাইভা একটি ফরমাল জায়গা। এখানে ‘ইয়েস’ বলাটা অপ্রাসঙ্গিক। তখন আমি তাকে বলি এখানে কি ‘ইয়েস স্যার বলা উচিত ছিল না? সে বলেছে স্যরি স্যার। আমি বলেছি, ইটস ওকে। এটাই সে ভাইভা শেষে বাইরে বেরিয়ে সবাইকে বলেছি আমি নাকি তাকে অনেকক্ষণ গালাগালি করেছি। অথচ আমার ২৪ বছরের শিক্ষকতার জীবনে আমি কাউকে গালি দেইনি। একজন অধ্যাপক তো পরে, কোনো প্রভাষকও এটা করতে পারে না।
ফেসবুকের বিষয়ে নজরদারি নিয়ে অভিযুক্ত ওই শিক্ষক বলেন, অধিকাংশের সঙ্গে আমি ফেসবুকে যুক্তই নেই। আমি এমনটা কখনোই করিনি। আর আমি খুব একটা ফেসবুক চালাইও না।
অভিযোগের সত্যতা জানতে বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল মনসুর আহমেদকে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার বলেন, আমরা ঘটনাটি শুনেছি। উপাচার্য মহোদয়কে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করেছি। সত্যিই এমনটি হয়ে থাকলে দুঃখজনক। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে সিদ্ধান্ত জানাব।
কেএইচ/পিএইচ