বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে দুঃসময় পার করছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। নির্বাচন ও আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জাতীয় রাজনীতির যে উত্তাপ তাতে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত রয়েছে ছাত্র সংগঠনগুলোও। তবে জোট গঠনসহ সরকার পতন আন্দোলনের মুখ্য ভূমিকা পালনের হাঁকডাক দিলেও অনেকটা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে বিরোধী ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল।

জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল। হারানো জৌলুস ফেরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে দলটির নেতাকর্মীরা। তবে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের অত্যধিক তৎপরতা, ক্যাম্পাসে ঢুকতে কঠোরভাবে বাধা প্রদান, দলের অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং শক্ত মনোবলের অভাবে আর ক্যাম্পাসে নিজেদের অবস্থান ফেরাতে পারেনি সংগঠনটির ঢাবি নেতাকর্মীরা।

তবে ঢাবি ক্যাম্পাসে যেকোনো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রতিবার ছাত্রলীগের হামলায় তা বাধাগ্রস্ত হয় বলে জানান ছাত্রদলের ঢাবি শাখা সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল এবং সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম। তাছাড়া দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল স্বীকার করলেও আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের এক দফা দাবিতে সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছাত্রদল মাঠে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান ঢাবির দুই শীর্ষ নেতা।  

চলতি বছরের পরিস্থিতি বিবেচনায় দেখা যায়, গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের পর থেকে বিএনপি লাগাতার হরতাল-অবরোধ দিলেও তাদের ছাত্রসংগঠন ঢাবি শাখা ছাত্রদল কয়েকটি ঝটিকা মিছিল করা ছাড়া সংগঠিত কোনো আন্দোলন দেখাতে পারেনি। ছাত্র রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে কোনো আন্দোলন করতে দেখা যায়নি। বিভিন্ন সময় ক্যাম্পাসের আশপাশে ঝটিকা মিছিল ও রাতের অন্ধকারে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গেইটে তালা মেরেই সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা গেছে তাদের।

এদিকে, ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা যখনই ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে চেয়েছে প্রতিবারই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বাধায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। ছাত্রদল পূর্ব ঘোষিত কোনো প্রোগ্রাম সফল করতে ক্যাম্পাসে আসলেই ক্যাম্পাসের কার্জন হল, দোয়েল চত্বর, টিএসসি, পলাশী মোড়, শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা ও নীলক্ষেত পয়েন্টসহ কয়েকটি স্থানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময় তাদের হামলায় ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের আহত হওয়ার খবরও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। 

আবার ক্যাম্পাসের আশেপাশে মিছিল চলাকালে পুলিশের হামলার ঘটনাও কম নয়। যার ফলস্বরূপ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে চাইলেও বারবার ছাত্রলীগ বা পুলিশি বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। তাই যেকোনো সময় হামলা-মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে থাকতে হয় নেতাকর্মীদের। সর্বত্র ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে রাখায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণও বাড়ছে না। এছাড়া ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগের ‘একক দখলদারিত্ব’ ও পুলিশ-ছাত্রলীগের ‘যৌথ নির্যাতনে’ বড় ধরনের আন্দোলনের সুযোগও পাচ্ছেন না তারা।

ছাত্রদল দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে অন্তত ৭ বার ছাত্রলীগের হামলার মুখোমুখি হয়েছে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এতে অন্তত ২০ নেতাকর্মী আহত হন। তাছাড়া ছাত্রলীগের মার খেয়ে উল্টো ৭ জন নেতাকর্মী ‘বিনা অপরাধে’ জেল খাটছেন বলে জানান ছাত্রদল নেতারা। তবে নেতাকর্মীর অপ্রতুলতার কারণেই শক্ত অবস্থান করে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারছে না বলেই দলের বেশ কিছু নেতাকর্মী মনে করেন। 

ছাত্রদলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে চাইলে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হই। ক্যাম্পাসের প্রবেশপথগুলোতে মিছিল করলে পুলিশের হামলার শিকার হই। আমাদের নেতারা এক হতে পারছেন না। নেতাকর্মীর সংখ্যা কম হওয়ায় আমরা বড় মিছিল নিয়ে সামনে যেতে না পারায় ছাত্রলীগ বা পুলিশের হামলার শিকার হচ্ছি। আমাদের কর্মীরা যদি শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অধীনে মিছিল করতো তাহলে আমরা এতটা আঘাতপ্রাপ্ত হতাম না বরং কর্মসূচি আরও ফলপ্রসূ হতো।

এদিকে, ঢাবি ছাত্রদলের অভ্যন্তরে রয়েছে নানা গ্রুপিং। গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর শাখা ছাত্রদলের সর্বশেষ কমিটি ঘোষণার পর থেকেই অসন্তোষ ছিল সক্রিয় কয়েকটি গ্রুপের মধ্যে। ফলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বাইরেও গ্রুপগুলোর আলাদাভাবে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক আড্ডা ও অন্যান্য কার্যক্রম চলমান ছিল। সেসময় একই ইস্যুতে দুই-তিনটি করে মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি দেখা যায়। এর মধ্যেই শাখা সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গেলে গ্রুপিংয়ের মাত্রা ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। একপর্যায়ে সংগঠনের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব ও বিভিন্ন চাপে ধীরে ধীরে এক ব্যানারে কাজ করা শুরু করলেও বিভিন্ন গ্রুপিং রয়েই যায়। 

ঢাবি শাখা ছাত্রদলের অভ্যন্তরে বিভিন্ন গ্রুপিং থাকার ফলে ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক কর্মসূচিগুলোতে জনবলের ঘাটতি দেখা যায়। শাখায় সক্রিয় কর্মী দুই শতাধিক হলেও দলের মূল ব্যানারে মাত্র বিশ থেকে পঁচিশজন নিয়ে কর্মসূচি করতে হচ্ছে নেতাদের। পর্যাপ্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জনশক্তির অভাবে ক্যাম্পাস বা আশপাশেও দীর্ঘসময় মিছিল করতে দেখা যায় না তাদের। এই দুঃসময়ে গ্রুপিংয়ের রাজনীতি থেকে বের হতে না পারার কারণে দলটি সক্রিয় হতে পারছে না বলে মনে করা হচ্ছে।

ঢাবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম বলেন,  আজকে রাষ্ট্র যখন ফ্যাসিবাদী শাসকের কবলে তখন রাষ্ট্রীয় বাহিনী সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করছে। চলমান ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে আমাদের অনেক সহযোদ্ধা কারাগারে বন্দি। ক্যাম্পাসে তাদের সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে আজকে কোনো প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার পরিবেশ নেই এবং কেউ স্বাভাবিক কর্মসূচি করতে পারছে না।

তিনি আরও দাবি করেন, ক্যাম্পাসে সরকার দলীয় সংগঠন ছাত্রলীগ আজকে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত হয়েছে। আমরা এখন এক ও ঐক্যবদ্ধ রয়েছি। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমরা দলীয় সব কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি। আমরা প্রস্তুত আছি এবং আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকেই ফ্যাসিবাদের কবর রচনা করব ইনশাআল্লাহ।

ক্যাম্পাসে প্রবেশে ছাত্রলীগের বাধা উল্লেখ করে ছাত্রদলের ঢাবি সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর যাবত একটি দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও তার দলীয় বাহিনীকে জনগণ ও বিরোধী দলের মত প্রকাশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে ফ্যাসিবাদে পরিণত হয়েছে। ছাত্রদল সাধারণ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে যতবার ক্যাম্পাসে গিয়েছে ততবারই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন সরাসরি সরকার দলীয় সংগঠন ছাত্রলীগকে সহযোগিতা করে আসছে।

তিনি বলেন, আমরা বারবার ক্যাম্পাসে গিয়েছি এবং হামলার প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ছাত্রলীগের অস্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অস্ত্রের মুখে আমাদের টিকে থাকা অনেক কঠিন। এরপরও আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক অধিকার আদায়ে ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দেশনায়ক তারেক রহমানের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ জনগণ ও আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত। 

রাজপথে নামলেই হামলা-মামলা প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, দেখুন দীর্ঘ ১৫ বছর যাবত একটি দল ক্ষমতার বাহিরে, ক্যাম্পাসে ন্যূনতম সহাবস্থান নেই। ক্যাম্পাসে ক্লাস-পরীক্ষা দিতে গিয়েও আমাদের নেতাকর্মীদের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। মামলা-জেল-জুলুম তো আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। আমি নিজেও ৪ বার হামলার শিকার ও তিনবার জেল খেটেছি। গলায় মামলার খড়গ ঝুলছেই। বর্তমানে আমাদের ৭ জন নেতা কারাগারে রয়েছেন। এটা সত্য আমাদের কর্মী সংখ্যা কিছুটা কম কিন্তু আমাদের প্রতিটি নেতাকর্মী রাজপথে যথেষ্ট পরীক্ষিত।

ক্যাম্পাসে প্রবেশে বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, ছাত্রদল যদি ক্যাম্পাসে একজোট হয়ে ভালো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে আসে আমরা তাদের কখনো বাধা দেবো না। কিন্তু তারা বিভিন্ন গ্রুপ হয়ে আসে ক্যাম্পাসে অগ্নিসন্ত্রাস চালাতে, পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করতে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের রক্ষায় বদ্ধপরিকর। তাই শিক্ষার্থীদের রক্ষার্থেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছাত্রদলকে ক্যাম্পাসে প্রবেশে বাধা দিয়ে থাকে। তাছাড়া এটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সাংগঠনিক অদক্ষতাকে চেপে রাখতেই তারা আমাদের দিকে আঙুল তুলে।

কেএইচ/পিএইচ