রাইড শেয়ারিং বন্ধ, পণ্য ডেলিভারি করেন ঢাবি শিক্ষার্থী
মোটরসাইকেলভর্তি শপিং ব্যাগ। পেছনে বড় একটি ব্যাগ রশি দিয়ে বাঁধা। সেটির সঙ্গে ঝুলছে আরও কয়েকটি ছোট ছোট শপিং ব্যাগ। চালকের আসনে হেলমেট পরে বসা এক যুবক।
মঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) সচিবালয়ের গেটে হঠাৎ থামতেই অনেকের দৃষ্টি কাড়ে এই মোটরসাইকেল। উৎসুক পথচারী বাইকটি ঘিরে ধরেন। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে চালক নিজের পরিচয় দেন। নাম মো. আব্দুর রহমান। পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধীনে ভাষাতত্ত্বের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তিনি।
বিজ্ঞাপন
কথা প্রসঙ্গে আব্দুর রহমান বলেন, কৃষক বাবার পক্ষে আমার পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব নয়। করোনার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হলেও নিয়মিত অ্যাসাইমেন্ট দিচ্ছে। আবাসিক হল বন্ধ থাকায় ধানমন্ডি-১৫ নম্বরের একটি ছাত্রাবাসে উঠেছি। খরচ আরও বেড়েছে। টাকার জন্য আগে পড়াশোনার ফাঁকে পাঠাও-উবারের মাধ্যমে রাইড শেয়ারিং করতাম। বর্তমানে রাইড শেয়ারিং বন্ধ থাকায় খরচ চালাতে পণ্য ডেলিভারির কাজ শুরু করেছি।
যশোরের কেশবপুরের কৃষক পরিবারে জন্ম আব্দুর রহমানের। দুই ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়। তিনি জানান, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরে তার কৃষক বাবার পক্ষে লেখাপড়ার খরচ চালানো কঠিন হয়ে যায়। নিয়মিত খরচের টাকা পাঠাতে না পারায় লেখাপড়া বিঘ্নিত হয়। এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। হতাশার মধ্যেই আব্দুর রহমান খুঁজে পান নিজের আয়ে লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে নেওয়ার পথ।
জানতে চাইলে আব্দুর রহমান বলেন, হঠাৎ ভাবনায় এলো ঢাকা শহরে বাইক চালানো অর্থ আয়ের একটি ভালো উপায়। পাঠাও-উবারের মাধ্যমে রাইড শেয়ারের মাধ্যমে দৈনিক ২০০-৩০০ টাকা আয় করা সম্ভব।
ক্লাসের ফাঁকে কাজটি করতে তেমন কষ্ট হবে না বাবাকে বুঝিয়ে বলি। অনেক কষ্ট করে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে বাইক কিনে দেন বাবা। বাইক কেনার পর বাড়ি থেকে আর টাকা আনতে হয়নি। নিজের খরচ চালিয়ে বাড়িতেও টাকা পাঠাই।
আবদুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকার সময় টাকার প্রয়োজরন দিনে ২-৩টি রাইড শেয়ার করতাম। আগে ইচ্ছেমতো কাজ করতাম। এখন সেটা সম্ভব হচ্ছে না। অফিসে সকাল ৯টার মধ্যে যেতে হয়। কল সেন্টার থেকে পার্সেল নিতে হয়। আমাদের বেশিরভাগ পণ্য ক্যাশ অন ডেলিভারি। টাকা পয়সার সব হিসাব বুঝিয়ে মেসে যেতে রাত হয়ে যায়।
পণ্য ডেলিভারির কাজে কীভাবে যুক্ত হলেন জানতে চাইলে ঢাবির এই শিক্ষার্থী বলেন, বিক্রয় ডটকমে বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করি। ইন্টারভিউ দিলে নলেজ প্রোডাক্টস অ্যান্ড অনলাইন শপিং সেন্টার আমাকে কাজ দেয়।
প্রতিদিন কত টাকা আয় হয় জানতে চাইলে রহমান বলেন, প্রতি পার্সেল ডেলিভারিতে ৮০ টাকা দেওয়া হয়। ১০ টাকা করে প্রভিডেন্ড ফান্ডের জন্য কেটে রাখে। প্রতিদিন ১৫-২০টি পার্সেল ডেলিভারি দিতে পারি। গড়ে দিনে এক হাজার টাকার বেশি আয় হয়। অফিস প্রতিদিনের কাজের টাকা প্রতিদিন দিয়ে দেয়।
ডেলিভারির কাজ করতে গিয়ে পড়াশোনা বিঘ্নিত হয় না দাবি করে রহমান বলেন, আমি বেশি সময় বাইরে কাটাই না। ডিপার্টমেন্টের চাপ আছে। ক্লাসে উপস্থিতির ক্ষেত্রে অনেক কড়াকড়ি। নিয়মিত উপস্থিত না হলে পরীক্ষায় অংশ নিতে দেয় না। করোনার মধ্যেও আমাদের অ্যাসাইনমেন্ট দেয়। অফিসের কাজ শেষ করে রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুমাই। তারপর উঠে পড়তে বসি। রাত ২-৩টা পর্যন্ত পড়াশোনা করি।
করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ থাকায় বর্তমানে ধানমন্ডির-১৫ নম্বরে একটি মেসে থাকেন রহমান। বাসা ভাড়া তিন হাজার, বাইক পার্কিংয়ের জন্য ৫০০, খাওয়াসহ সব মিলিয়ে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা খরচ হয়। সবই নিজের আয় থেকে খরচ করেন। কোনো ধরনের নেশা তো দূরের কথা চা-ও পান করেন না রহমান। সব খরচ মিটিয়ে ভালোভাবে চলছে তার জীবন। প্রতি মাসে বাড়িতেও পাঠান তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা।
রহমান বলেন, টাকার দিকে ঝোঁক এসে গেলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে। নিজে বাঁচার জন্য সাময়িক এ কাজ করি। আমার স্বপ্ন বিসিএস কর্মকর্তা হওয়া। জনগণের সেবা করা।
আব্দুর রহমান বলেন, আগে রকমারি ডটকমের কল সেন্টারে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করতাম। সেখানে তেমন টাকা পেতাম না। এই সময় সবাই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে কাটায়। আর আমি চার ঘণ্টা কাজ করে ছয় হাজার টাকা পেতাম। ১০টার সময় কাজ শেষ করে ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসতাম। তখন আমার বাইক ছিল না।
ডেলিভারির কাজকে বেশ উপভোগ করছেন রহমান। তিনি বলেন, কোনো কাজকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। ঢাকা শহরে এ ধরনের কাজ অনেকে করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে মোটরসাইকেলে মানুষের মালামাল বা পণ্য ডেলিভারির কাজ করা নিয়ে একটুও ভাবি না। বরং ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক বাবাকে কষ্ট না দিয়ে নিজের আয়ে চলি। পরিবারকে সহযোগিতা করি। পড়ালেখাও করছি। ঢাকায় একটা বাইক থাকলে নিজের পড়ার খরচ নিজে চালানো সম্ভব।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে রহমান বলেন, আমি বিসিএস পরীক্ষা দেবো। এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি। কাজ শেষে বাসায় গিয়ে ঘুমাই। ঘুম থেকে উঠে ক্লাসের পড়া শেষে বিসিএসের জন্য অল্প অল্প করে পড়ি।
এনএম/ওএফ /জেএস