‘সাইবার বুলিং ও অনলাইনের ক্ষতিকর প্রভাব রোধে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি ও দক্ষতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক একটি বিশেষ কার্যক্রম চলছে সারা দেশে। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর এবং মানসিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘মনের বন্ধু’র সহায়তায় এ আয়োজন করেছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)।

এ উদ্যোগের প্রাথমিক লক্ষ্য হলো সচেতনতা তৈরি করা ও সহায়তা দেওয়া; বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের। যেন তারা সাইবার বুলিং থেকে রক্ষা পেতে পারে এবং নিজের সুরক্ষিত রাখতে পারে। জাতীয় পর্যায়ের এই কার্যক্রমটি ইউএনডিপি-ডিপিপিএ’র যৌথ বৈশ্বিক উদ্যোগ ‘ইন্টেগ্রেটিং মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড সাইকোসোশ্যাল সাপোর্ট (এমএইচপিএসএস) ইন কনফ্লিক্ট প্রিভেনশন অ্যান্ড পিসবিল্ডিং’ এর অংশ।

বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ অনলাইন সংযোগের সুফল পাচ্ছে, একই সঙ্গে মোকাবিলা করছে সাইবার বুলিং ও অনলাইনে হয়রানির চ্যালেঞ্জও। বিশেষ করে নারীদের সঙ্গে সাইবার বুলিং ও অনলাইনে হয়রানির ঘটনা বেশি ঘটছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের পরিবার, সেই সঙ্গে পুরো সমাজ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব আইসিটি ইন ডেভেলপমেন্টের (বিআইআইডি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী নারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে সাইবার বুলিংয়ের শিকার।

তাই মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইউএনডিপির নেওয়া এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘আমরা ডিজিটাল ক্ষেত্রে খুব দ্রুত উন্নতি করছি। এই উন্নতির সময়ে আমাদের শুধু এর ভালো দিকটি দেখলেই চলবে না, বরং এর ফলে উদ্ভূত ক্ষতিকর প্রভাবগুলো সম্পর্কেও সচেতন থাকতে হবে। সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা শুধুই একটি প্রচারণা নয়, ডিজিটাল উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার পথে একটি বড় পদক্ষেপ।’

ইউএনডিপির পার্টনারশিপস ফর আ মোর টলারেন্ট, ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ (পিটিআইবি) প্রকল্পের অংশ হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য একযোগে কাজ করছে ইউএনডিপি ও ‘মনের বন্ধু’। এ কার্যক্রমে সহযোগিতা করছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন পিস ক্যাফে। এ ছাড়া জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের আওতাধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস (সিপিজে), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি), সিবিএম গ্লোবাল ডিজ্যাবিলিটি ইনক্লুশন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং ইউএন উইমেনের বিশেষজ্ঞরা দিচ্ছেন পরামর্শ ও নির্দেশনা।

গত ৪ থেকে ৯ নভেম্বর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে এই উদ্যোগের সূচনা হয়। ১৮ ও ১৯ নভেম্বর ‘মনের বন্ধু’র বিশেষজ্ঞরা প্রশিক্ষণ দেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রশিক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয় দুটির ছয় শ’র বেশি নারী শিক্ষার্থী অংশ নেন। অনলাইনে হয়রানি ও ক্ষতিকর প্রভাব প্রতিরোধের কৌশল সম্পর্কে ধারণা ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পান তারা।

এই উদ্যোগ সম্পর্কে ইউএনডিপি বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার বলেন, ‘সবার জন্য নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল পরিবেশ তৈরির পথে এটি গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ, যে পরিবেশে সবাই নির্ভয়ে নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারবে। আর তাহলেই আমরা সবাই মিলে এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে পারব, যেখানে ডিজিটাল স্পেস হবে সাইবার বুলিং মুক্ত, এবং নিশ্চিত হবে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতা।’

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, ‘সাইবার বুলিং শুধু একটি ডিজিটাল চ্যালেঞ্জই নয়, এটি একটি মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের এমন একটি পথ দেখাতে চাই, যে পথে তারা আত্মবিশ্বাস ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে।’

সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিচালক মঞ্জুর হাসান ওবিই বলেন, ‘ডিজিটাল দুনিয়া আমাদের সামনে অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। কিন্তু আমাদের মানসিকভাবে সুস্থ থাকার পথে অন্তরায়ও হয়ে উঠছে। আর তাই আজ আমরা শুধু একটি আয়োজনকে সমর্থনই দিচ্ছি না, বরং একটি মহৎ উদ্যোগকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। এর ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা সাইবার বুলিংয়ের বিপদ সম্পর্কে জানবে, তাদের মানসিক দৃঢ়তা নিশ্চিত হবে।’

মনের বন্ধুর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদা শিরোপা বলেন, ‘মনের বন্ধু সব সময়ই একটি লিঙ্গ-সংবেদনশীল ও শক্তিশালী কমিউনিটি তৈরি করতে চায়। সেই দিক থেকে বলতে গেলে  ‘আমিই মনের বন্ধু’ প্রশিক্ষণটি তরুণদের মধ্যে ইতিবাচক বিষয়গুলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় পদক্ষেপ। অনলাইনের ক্ষতিকর প্রভাব এবং সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে কীভাবে একজন সুস্থ, সমৃদ্ধ মানুষ হয়ে ওঠা যায়, আমাদের প্রশিক্ষণার্থীরা তা বুঝতে শুরু করেছেন।’

সাইবার বুলিংয়ের কারণে মানসিক স্বাস্থ্য কীভাবে দৃঢ় করা যায়, সে বিষয়ে এই জাতীয় ক্যাম্পেইন চলবে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত। সাইবার বুলিং ও অনলাইনের ক্ষতিকর প্রভাবে সৃষ্ট মানসিক চাপ মোকাবিলায় তরুণদের দক্ষ করে তুলতে এই উদ্যোগ একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলে সংশ্লিষ্টদের বিশ্বাস।

এমজেইউ