৩য় বর্ষে এসেও গণরুমে থাকেন অনেক শিক্ষার্থী
ঢাবি হলে সিট পেতে ছাত্রলীগকে ‘মেনে চলতে’ হয়
তৃতীয় বর্ষে পা রাখলেও এখনো বৈধ আসন বরাদ্দ পাননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। তারপরও তারা হলে থাকছেন। বিনিময়ে ‘সময় দিতে’ হচ্ছে ছাত্রলীগকে। হলে থাকতে মিছিল-মিটিংসহ ছাত্রলীগের প্রায় সব কর্মকাণ্ডে বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে তাদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে এক প্রকার জিম্মি হয়ে আছেন— তাদের কথা মতো চলতে হয়, গেস্টরুমে যেতে হয়, প্রোগ্রামে যেতে হয়, মিছিল-মিটিং করতে হয়। নেতারা চাইলে সিট দেওয়া হয়, তারা না চাইলে সিট দেওয়া হয় না। বৈধ সিটের আশায় প্রোগ্রামে যাওয়াসহ ছাত্রলীগকে ‘মেনে চলেন’ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের প্রায় সব শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব হলে এই একই চিত্র বিরাজ করছে।
বিজ্ঞাপন
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ (১৯৭৩) অনুযায়ী আবাসিক হলে সিট দেওয়া, আবাসন সমস্যার সমাধানসহ সব কাজ পরিচালিত হওয়ার কথা হল প্রশাসনের নির্দেশে। কিন্তু বাস্তব চিত্র তার উল্টো। প্রতিটি হলেই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা এ কর্তৃত্ব নিয়ে নিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের সিট দিতে হল প্রশাসনকেই তাদের ম্যানেজ করতে হয়! একটি সিটের আশায় দীর্ঘদিন প্রোগ্রাম-গেস্টরুম করেন শিক্ষার্থীরা। হল প্রশাসন কিছুই করতে পারে না। তারা শুধু সিল আর স্বাক্ষর দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হলে থাকতে হলে স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয় শিক্ষার্থীদের। অংশ নিতে হয় ছাত্রলীগের সব প্রোগ্রামে, করতে হয় মিছিল-মিটিং। আর আবাসিক হলে থেকে নিজের ইচ্ছায় বা প্রয়োজনে যদি ছাত্রলীগের কোনো প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া না হয়, তা হলে গেস্টরুমে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় শিক্ষার্থীদের। এ নিয়ে প্রায়ই গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের বৈধ সিট নিশ্চিত করতে হল প্রশাসনের শক্ত ভূমিকা চোখে পড়ে না।
আরও পড়ুন
গত ৩ নভেম্বর কিছু শিক্ষার্থী নিয়মিত ‘প্রোগ্রাম’ না করায় অর্থাৎ মিছিলে না যাওয়ায় জহুরুল হক হলের বর্ধিত ভবনের ১০০৪ এবং টিনশেডের ১৩ নম্বর কক্ষ বন্ধ করে দেন ছাত্রলীগের নেতারা। এর কিছুদিন আগে সূর্যসেন হলের ২৩৪, ২৪৪ এবং ৩৫৪ নম্বর কক্ষে তালা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে গেস্টরুমে ডেকে নিয়ে আগামী দিনের সব প্রোগ্রামে শতভাগ উপস্থিত থাকতে হবে মর্মে মুচলেকা নিয়ে কক্ষের তালা খুলে দেওয়া হয়।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময় প্রোগ্রাম না করায় শিক্ষার্থীদের ‘হল ছাড়া’ করার বহু ঘটনা ঘটেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থীরা এখন দ্বিতীয় বর্ষ পার করে তৃতীয় বর্ষে উঠেছেন। একটা বৈধ সিটের আশায় ২ বছর ধরে নিয়মিত প্রোগ্রাম করেছেন তারা। কিন্তু এখনো সিট পাননি। এখনো তাদের নিয়িমিত মিছিল-মিটিং করতে হচ্ছে।
প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা এমনিতেই হলে বৈধ সিট পান না। প্রশাসন বলে, সিট নেই। ফলে এই দুই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়েই ‘ছাত্রলীগ করি’ মুচলেকা দিয়ে হলে অবস্থান করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, এফ রহমান হল, সূর্যসেন হল, জসীমউদ্দিন হল, জহুরুল হক হল, বিজয় একাত্তর হল ও জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
কয়েকটি হলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ১ম ও ২য় বর্ষের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী অনেক কষ্ট করে গাদাগাদি করে বিভিন্ন কক্ষে অবস্থান করছেন। ৮ জনের কক্ষে ১৬ জন, এমনকি কোথাও কোথাও ২০ জনও থাকছেন।
সবচেয়ে করুণ অবস্থা দেখা গেল বঙ্গবন্ধু হলে। সেখানে তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরাও এখনো গণরুমে অবস্থান করছেন। অর্ধেক শিক্ষার্থী ‘পলিটিক্যাল সিট’ পেলেও প্রায় ৪০ জন শিক্ষার্থী এখনো গাদাগাদি করে দুটি রুমে অবস্থান করছেন। অনেকে আবার রাতে ঘুমানোর জায়গা না পেয়ে টিভিরুম বা রিডিং রুমে ঘুমিয়ে পড়েন। পলিটিক্যাল রুমেও ৪ জনের জায়গায় ৮ জন থাকেন।
বিজয় একাত্তর হলের প্রায় সব শিক্ষার্থীকে প্রশাসন সিট দিয়েছে, কিন্তু সেগুলোতে তারা কেউ থাকতে পারেন না। একইভাবে সূর্যসেন হলের অনেক শিক্ষার্থীকে বৈধ উপায়ে সিট দেওয়া হলেও কেউ নিজের লিগ্যাল সিটে থাকতে পারেন না। সবাইকে পলিটিক্যাল রুমে থাকতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ করেন তারা।
জহুরুল হক হলের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথম বর্ষে গণরুমে ছিলাম। পরে একটা রুম পেলাম কিন্তু সেখানেও ১৪-১৫ জন থাকতে হচ্ছে। এখন তৃতীয় বর্ষে উঠেছি, এখনো মেইন বিল্ডিংয়ে একটা সিট পাইনি। প্রোগ্রাম না করলে ভাইয়েরা সিট দেবে না ভেবে এখনো প্রথম বর্ষের মতোই প্রোগ্রাম করে যাচ্ছি। প্রোগ্রাম না করলে গেস্টরুমে বকাবকি করা হয়, হল থেকে বের করে দেবে বলে হুমকি দেওয়া হয়। হল প্রশাসনও সিট দিতে পারে না। আমরা কী করব?
আরও পড়ুন
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একই হলের আরেক শিক্ষার্থী আক্ষেপ করে বলেন, মানুষ মারা গেলে মাটির নিচেও কমপক্ষে ২ হাত জায়গা পায় শুয়ে থাকার জন্য। আর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ বছর ধরে ১ হাত জায়গায় শুয়ে আছি। নিজের শরীরের নিচে বা উপরে হাত রাখা লাগে, না হয় হাত খাটের নিচে চলে যায়!
সূর্যসেন হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, হলে লিগ্যাল সিটের জন্য আবেদন করে বরাদ্দ পাওয়া গেলেও ওইসব কক্ষে বিভিন্ন কারণে উঠতে দেওয়া হয় না। বিপরীতৈ পলিটিকাল রুমে ২ জনের কক্ষে ৭-৮ জনকে থাকা লাগে। যেসব রুমে এলটমেন্ট দেওয়া হয় সেগুলো আবার পলিটিকাল রুম হিসেবেই পরিচিত হওয়ায় কেউ আসলে লিগ্যাল সিট পায় না। তৃতীয় বর্ষের শিক্ষাথী হিসেবে এটা খুবই অমানবিক মনে হয়।
বিজয় একাত্তর হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, হলে বৈধ সিট পেয়েছি অনেক আগেই কিন্তু ছাত্রলীগের নেতারা সেখানে উঠতে দেন না। তাছাড়া বরাদ্দকৃত অধিকাংশ কক্ষই ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে থাকায় বৈধ সিট পেয়েও নিয়মিত প্রোগ্রাম করতে হয়। ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে আমরা এক প্রকার জিম্মি হয়ে আছি।
এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক নিয়মেই হলগুলো পরিচালিত হচ্ছে। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, ছাত্রলীগের নেতাদের কথা বলার সুযোগ নেই। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই সিট পাচ্ছেন না। তারা ফ্লোরিং করে থাকছেন। হল প্রশাসনের কাছে আমাদের দাবি, তারা যেন আমাদের নেতাকর্মীদের সিট নিশ্চিত করে।
বৈধ সিট পাওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের পলিটিকাল রুমে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে, এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রশাসন সিট দেয় না কিন্তু আমরা আমাদের নেতাকর্মীদের প্রথম বর্ষ থেকেই সিট দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা তাদের বৈধ সিটে উঠতে বাধা দিচ্ছি এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট অভিযোগ। আমাদের কোনো কর্মীই এমন করতে পারে না, কখনো করবেও না।
আরও পড়ুন
জানতে চাইলে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আবদুর রহিম বলেন, আমি প্রতি বছর দুইবার সার্কুলার দিয়ে শিক্ষার্থীদের সিট দিচ্ছি। কিন্তু অনেকেই আবেদন করে না, যার ফলে তারা অনাবাসিক হিসেবে থেকে যায়। সামনে থেকে আমি কোনো অনাবাসিক শিক্ষার্থীকে রাখব না। আবাসিক অথবা দ্বৈতাবাসিক হিসেবে থাকতে হবে। হলে পলিটিক্যাল রুম বলতে কিছু নেই। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্স করবেই, এটা তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা। এ বিষয়ে আমি তাদের বাধা দিতে পারব না। যদি কোনো শিক্ষার্থীর থাকায় সমস্যা হয় তাহলে তারা আমার সঙ্গে কথা বলুক, আমি সেই সমস্যা সমাধান করে দেব।
বিজয় একাত্তর হলের প্রায় সব শিক্ষার্থীকে প্রশাসন সিট দিয়েছে, কিন্তু সেগুলোতে তারা কেউ থাকতে পারেন না। একইভাবে সূর্যসেন হলের অনেক শিক্ষার্থীকে বৈধ উপায়ে সিট দেওয়া হলেও কেউ নিজের লিগ্যাল সিটে থাকতে পারেন না। সবাইকে পলিটিক্যাল রুমে থাকতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ করেন তারা।
মাস্টার দ্যা সূর্যসেন হলের প্রাধ্যাক্ষ অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন ভূঁইয়া বলেন, বৈধ সিট পেয়েও সে তার সিটে উঠতে পারছে না এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে আসেনি। তবে প্রতিটি হলেই পলিটিক্যাল কিছু বিষয় থাকে যা আমার হলেও রয়েছে। তবে কেউ যদি তার সিট নিয়ে সমস্যায় পড়ে আমার কাছে আসলে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করে দিই এবং তাকে সেই সিটে উঠিয়ে দেওয়া হয়। কেউ যদি সিট পেয়েও উঠতে না পারে তাহলে সে যেন আমাদের সঙ্গে কথা বলে। আমরা সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, যেহেতু শিক্ষার্থীরা তৃতীয় বর্ষে উঠেছে সেহেতু তাদের হলে বৈধ সিট পাওয়ার কথা। আমরা দেখার চেষ্টা করছি কোন হলে কত শিক্ষার্থী থাকে, কতজন সিট পেয়েছে বা পায়নি। যারা সিট পায়নি তাদের লিগ্যাল সিট নিশ্চিত করা হবে। কয়েকদিন আগে প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠক হয়েছে, সেখানেও শিক্ষার্থীদের দ্রুত সিট নিশ্চিত করার বিষয়ে আমরা জোর দিয়েছি।
বৈধ সিট পেয়েও পলিটিক্যাল রুমে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে, এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। তবুও আমরা হল প্রাধ্যাক্ষদের মাধ্যমে বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে দেখব। কেন তারা বৈধ সিট পেয়েও থাকছে না বা তাদের কেন রুমে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না সেটা খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কেএইচ/এসকেডি