হাইকোর্টের আদেশ তোয়াক্কা না করেই ঢাবিতে সিঅ্যান্ডডি মিটিং
হাইকোর্টের আদেশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে কো-অরডিনেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কমিটির (সিঅ্যান্ডডি) মিটিং সম্পন্নের অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে। নিয়মানুযায়ী মিটিংয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের অধ্যাপক ও সিঅ্যান্ডডি কমিটির সদস্যদের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও এ নিয়মের তোয়াক্কা করেননি বিভাগীয় চেয়ারম্যান।
সম্প্রতি এমন অভিযোগ তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রবীর কুমার সরকারের কাছে লিখিত অভিযোগপত্র দিয়েছেন একই বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এ কে এম রেজাউল করিম।
বিজ্ঞাপন
অধ্যাপক ড. এ কে এম রেজাউল করিম জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি বিভাগের এক-তৃতীয়াংশ সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত হয় সিঅ্যান্ডডি কমিটি। গত ২১ সেপ্টেম্বর মনোবিজ্ঞান বিভাগে এই মিটিং সম্পন্ন হয়। যেখানে আমি ছাড়াও আরও দুইজন সদস্য অধ্যাপক ড. আয়েশা সুলতানা ও আরিফা রহমান অনুপস্থিত ছিলেন। এ অবস্থায় মিটিং চালিয়ে নেওয়া আদালত অবমাননার শামিল।
আরও পড়ুন- দুর্নীতির অভিযোগ করায় ‘অব্যাহতি’, উপেক্ষিত হাইকোর্টের রায়!
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ সেপ্টেম্বর লিখিত অভিযোগপত্রটি জমা দেন অধ্যাপক ড. এ কে এম রেজাউল করিম। যেখানে তিনি সংশ্লিষ্ট বিভাগের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
অভিযোগপত্রে শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, হাইকোর্টের আদেশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ও আদেশ না মেনে আমাকে বাদ রেখেই মনোবিজ্ঞান বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন গত ২১ সেপ্টেম্বর সিঅ্যান্ডডি সভা করেছেন। যা আদালত অবমাননাসহ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের শামিল।
লিখিত অভিযোগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, ঘটনার শুরু ২০২২ সালের ২০ জুন, যখন মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. কামালের বিরুদ্ধে স্টোর কিপার নিয়োগে দুর্নীতিসহ ১২টি অভিযোগ তুলে ধরা হয়। একইসঙ্গে সিন্ডিকেট কর্তৃক তদন্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভিসি প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামানের নিকট লিখিত অভিযোগ দেন বিভাগেরই সাতজন শিক্ষক। বিষয়টি সুরাহা করতে আশ্বাস দিলেও দুই মাসেও তদন্ত হয়নি। পরে, ২৪ আগস্ট আরো কিছু অভিযোগের তথ্য যুক্ত করে পুনরায় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ভিসি বরাবর দ্বিতীয় চিঠি লেখেন ওই সাত শিক্ষক।
মূলত চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় ঐ বছরের ৪ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কমিটির এক বৈঠকে বিভাগের শিক্ষক সোহেল রানা ও সেলিম হোসেন চেয়ারম্যানের সঙ্গে সমঝোতা করতে বলেন। কিন্তু, সমঝোতা না করায় অধ্যাপক রেজাউল করিমকে মিটিং থেকে বের করে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ২০১৬ সালের আদালতের মাধ্যমে মীমাংসিত একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে তাকে সাময়িক অব্যাহতি প্রদান করা হয়।
অব্যাহতির পরে গত ৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন আইনের উপর ভিত্তি করে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে- তা চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীনের নিকট তিন কর্মদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে জানতে চান শিক্ষক রেজাউল করিম। একই চিঠি রেজিস্ট্রারের কাছেও পাঠান। কিন্তু, বছর পেরিয়ে গেলেও কেউ চিঠির জবাব দেয়নি। এ ঘটনার প্রতিবাদে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে দুই সপ্তাহের জন্য কর্মবিরতিতে যান অভিযোগকারী ৭ শিক্ষক। পরবর্তীতে ১৩ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক রেজাউল করিমকে অব্যাহতির জবাব চেয়ে উপাচার্য বরাবর চিঠি দেন ৬ শিক্ষক। কিন্তু, উপাচার্য এই চিঠিরও কোনো জবাব দেননি।
পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, রেজিস্ট্রার ও বিভাগের চেয়ারম্যানকে বিবাদী করে উচ্চ আদালতে একটি রিট করেন অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম। রিটে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি বহির্ভূত এবং তা স্থগিতাদেশ চান এ শিক্ষক। এরপর চলতি বছরের ৪ এপ্রিল একাডেমিক সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন আদালত। এ রায় আসার প্রায় ৬ মাস পার হলেও এখনো রেজাউল করিমকে কোনো একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাকে এখনও কোনো ক্লাস দেওয়া হয়নি। কেন দেওয়া হচ্ছে না— তা আমার বোধগম্য নয়। মহামান্য হাইকোর্ট আমার পক্ষে রায় দিয়েছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেরিতে হলেও রায় অনুমোদন করেছেন। তবুও আমাকে ২১ সেপ্টেম্বরের সিঅ্যান্ডডি মিটিংয়ে রাখা হয়নি।
তিনি বলেন, আমাকে মিটিংয়ের জন্য কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি। কিন্তু, সিনিয়র হিসেবে আমার নাম সবার উপরে থাকার কথা।
তিনি আরও বলেন, কয়েকদিন আগে আমাকে একাডেমিক কমিটির পক্ষ থেকে প্রতিনিধি পাঠিয়ে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল- আমি যেন এত লেখালেখি না করি। আমি বলেছি, এই বিভাগে যতদিন চাকুরি করবো আমার কলম কেউ থামাতে পারবে না। বিচার না পেলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমি লিখবোই। যদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাতজন শিক্ষকের প্রথম অভিযোগটি আমলে নিয়ে তদন্ত করে বিচার করত তাহলে অধ্যাপক কামাল উদ্দিন এত অন্যায়-অবিচার, জুলুম, নির্যাতন করার সাহস ও প্রশ্রয় পেত না।
অভিযোগের বিষয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামাল উদ্দিন বলেন, তার (অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম) বেফাঁস মন্তব্যের জন্য অতীতেও দুইবার একাডেমিক কার্যক্রম থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। তিনি সবার কাছে এ বিষয়ে ক্ষমা চেয়ে পরিত্রাণ পেয়েছিলেন। সম্প্রতি তিনি ই-মেইলে সবাইকে ঢালাওভাবে খারাপ বলেছেন।
মিটিংয়ে কেন তাকে যুক্ত করা হয়নি— জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা মিটিংয়ে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি দেখেছি। শিক্ষক নিয়োগের কাজ সিলেকশন বোর্ড করবে, এটা আমাদের কাজ না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে বিভাগে অ্যাকাডেমিক মিটিং থেকে উনাকে যুক্ত করা হবে।
অধ্যাপক রেজাউল করিমকে কেন ক্লাস দেওয়া হচ্ছে না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোর্স বন্টণ করা হয় সেশনের শুরুতে। মাঝখানে কোর্স দেওয়া যায় না। পরবর্তী সেশনে তিনি কোর্স পাবেন। এর আগে তিনি ৪র্থ বর্ষ ও মাস্টার্সের ক্লাস নিয়েছেন। একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতির কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়।
অন্য দুজন শিক্ষকের মিটিংয়ে না আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের ব্যর্থতার জন্য তারা মিটিংয়ে উপস্থিত হতে পারেনি। তারা বৃহস্পতিবার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে যান। শিক্ষিকা আরিফা রহমান আমাকে বলেছিলেন- নতুন হাউজে টিউটর হওয়ায় ব্যস্ততার জন্য মিটিংয়ে আসতে পারেনি।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. আয়েশা সুলতানা বলেন, আমরা রেজাউল করিম স্যারের বিষয়কে সাপোর্ট করছি বলে অনেক আগে থেকেই সব বয়কট করেছি। তবে, মধ্যে কিছুদিন আমরা মিটিংগুলোতে উপস্থিত ছিলাম। সর্বশেষ সিঅ্যান্ডডি মিটিংয়েও রেজাউল স্যারকে চিঠি দেওয়া হয়নি অথচ তিনি অনেক সিনিয়র শিক্ষক।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রবীর কুমার সরকার বলেন, এটা চেয়ারম্যানের বিষয়। চেয়ারম্যানকে অনেক আগেই বলেছি তাকে একাডেমিক কাজে যুক্ত করতে এবং হাইকোর্টের রায় মেনে নিতে। তবে, তিনি কেন গড়িমসি করছেন তা আমি জানি না।
অধ্যাপক রেজাউল করিমের চিঠি পেয়েছেন এবং সেটা উপাচার্য অফিসে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
কেএইচ/এমজে