ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যানের দুর্নীতি ও বিভিন্ন অন্যায় কর্মকাণ্ড তুলে ধরে উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন ওই বিভাগের সাত শিক্ষক। তাদের অভিযোগ আমলে তো নেওয়াই হয়নি, উল্টো ‘অভিযোগ করায়’ সেই সাত শিক্ষকের একজনকে বিভাগীয় চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

বাধ্য হয়ে এ বিষয়ে প্রতিকার পেতে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন ওই শিক্ষক। আদালত থেকে তার পক্ষে রায়ও আসে। কিন্তু সেটিও কার্যকর হচ্ছে না। পাঁচ মাস পার হলেও রায় কার্যকর নিয়ে চলছে নানা টালবাহানা!

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিন্ডিকেটের তদন্ত ব্যতীত বিভাগীয় চেয়ারম্যান কর্তৃক একাডেমিক কার্যক্রম থেকে শিক্ষককে অব্যাহতি প্রদান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশবিরোধী। অন্যদিকে, হাইকোর্টের রায় কার্যকর না করা আদালত অবমাননারও শামিল।

ভুক্তভোগী অধ্যাপক ড. এ কে এম রেজাউল করিম জানান, তার অব্যাহতিপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিপরিপন্থি এবং এখতিয়ার বহির্ভূত। এ বিষয়ে হাইকোর্ট থেকে রায়ও দেওয়া হয়। কিন্তু ভিসি, প্রো-ভিসি (প্রশাসন ও শিক্ষা), ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্যরা পাঁচ মাস ধরে রায়টি কার্যকর করছেন না। এটি কার্যকরের দায়িত্ব একে-অপরের ঘাড়ে চাপিয়ে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

আরও পড়ুন : সংখ্যায় এগিয়েও নেতৃত্বে পিছিয়ে ঢাবির নারী শিক্ষকরা

ঘটনার শুরু ২০২২ সালের ২০ জুন। ওই দিন মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. কামালের বিরুদ্ধে স্টোর কিপার নিয়োগে দুর্নীতিসহ ১২টি অভিযোগ তুলে ধরে সিন্ডিকেট কর্তৃক তদন্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ওই বিভাগেরই সাত শিক্ষক। তখন বিষয়টি সুরাহার আশ্বাস দেওয়া হলেও পরে কোনো তদন্তই করা হয়নি। এ কারণে দুই মাস পর ২৪ আগস্ট আরও কিছু অভিযোগের তথ্য যুক্ত করে পুনরায় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ভিসি বরাবর চিঠি লেখেন ওই সাত শিক্ষক।

চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কমিটির এক বৈঠকে অধ্যাপক ড. রেজাউল করিমকে বিভাগের শিক্ষক সোহেল রানা ও সেলিম হোসেন চেয়ারম্যানের সঙ্গে সমঝোতা করতে বলেন। যা একাডেমিক কমিটির ওই সভার রেজুলেশন হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়।

ওই সভায় মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. সোহেল রানা অধ্যাপক রেজাউল করিমকে বলেন, প্রস্তাবটি মেনে নেন। আপনার ভালো হবে। নতুবা আপনার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব। সেই প্রস্তাবে রাজি হননি অধ্যাপক রেজাউল করিম। তিনি সমঝোতার আগে বিষয়টির তদন্ত হওয়া দরকার বলে জানান।

সমঝোতা না করায় সেদিন অধ্যাপক রেজাউল করিমকে বৈঠক থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে ৮ সেপ্টেম্বর চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীন স্বাক্ষরিত চিঠিতে ২০১৬ সালে আদালতের মাধ্যমে মীমাংসিত একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে তাকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ সময় অন্য ছয় শিক্ষকের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি।

এ বিষয়ে ড. রেজাউল করিম বলেন, তখন (২০১৬ সালে) অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন একজন ছাত্রীকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করেছিলেন, যা সফল হয়নি। সেই পরিকল্পনার অডিও আমার কাছে আছে। তবে, সেই সময়ও তারা একই কায়দায় আমাকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় তারা খুশি মতো আমার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আর আমি বারবার আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছি। এবার তাতেও কাজ হচ্ছে না। ওনারা আমাকে জোর করে দুর্নীতির সঙ্গে সমঝোতা করাতে চান, যা কখনওই সম্ভব নয়।

সাময়িক অব্যাহতির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে বলা আছে, সিন্ডিকেট কর্তৃক তদন্ত এবং সেই তদন্তে দোষ প্রমাণ ব্যতীত বিভাগীয় চেয়ারম্যান বা একাডেমিক কমিটি কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দিতে পারবেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডার ২০০৩ এর ৪৫ (৩ ও ৪) আর্টিকেলে বলা হয়েছে, ‘সিন্ডিকেট কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়া কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তাকে শাস্তি প্রদান করা যাবে না।’ অথচ, অধ্যাপক রেজাউল করিমকে এ নিয়মের তোয়াক্কা না করে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, হাইকোর্টের আদেশ সত্ত্বেও তাকে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেওয়া হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিন্ডিকেটের তদন্ত ব্যতীত বিভাগীয় চেয়ারম্যান কর্তৃক একাডেমিক কার্যক্রম থেকে শিক্ষককে অব্যাহতি প্রদান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশবিরোধী। অন্যদিকে, হাইকোর্টের রায় কার্যকর না করা আদালত অবমাননারও শামিল

আরও পড়ুন : বারান্দায় থেকেই স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করলেন ঢাবি শিক্ষার্থী!

অব্যাহতি পাওয়ার পর গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর ভুক্তভোগী শিক্ষক রেজাউল করিম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন আইনের ওপর ভিত্তি করে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে তা বিভাগের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীনের কাছে তিন কর্মদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে জানতে চান। একই চিঠি রেজিস্ট্রারের কাছেও পাঠানো হয়। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও কেউ চিঠির জবাব দেয়নি বলে জানান ভুক্তভোগী শিক্ষক। এ ঘটনার প্রতিবাদে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে দুই সপ্তাহের জন্য কর্মবিরতিতে যান অভিযোগকারী অন্য ছয় শিক্ষক। এ সময় পরীক্ষা ব্যতীত সব কার্যক্রম থেকে তারা বিরত থাকেন।

১৩ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক রেজাউল করিমের অব্যাহতির বিষয়ে জবাব চেয়ে উপাচার্য বরাবর চিঠি দেন ওই ছয় শিক্ষক। কিন্তু উপাচার্য সেই চিঠিরও কোনো জনাব দেননি। এ ছাড়া, সিন্ডিকেট কর্তৃক যথাযথ তদন্তের জন্য শিক্ষক সমিতির কাছে লিখিত আবেদনের মাধ্যমে সহযোগিতা চাওয়া হয়। সেখানেও আশ্বাস ব্যতীত কোনো সুফল পাওয়া যায়নি।

উপাচার্যকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, ‘আমরা মনোবিজ্ঞান বিভাগের সাত শিক্ষক বর্তমান চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিনের দুর্নীতি ও অন্যান্য অন্যায় কর্মকাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট কর্তৃক তদন্তপূর্বক বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আপনাকে পরপর দুটি অনুরোধপত্র দিয়েছিলাম। কিন্তু সে অনুযায়ী দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিভাগের চেয়ারম্যান একের পর এক তার অন্যায় কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে ৪ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কমিটির সভায় প্রফেসর রেজাউল করিমকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্স পরিপন্থি। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এসব বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে পূর্ণাঙ্গ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমরা নিম্ন স্বাক্ষরকারী শিক্ষকরা বিভাগীয় একাডেমিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

২৬ সেপ্টেম্বর শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে এবং নানা চাপে পড়ে কর্মবিরতি সীমিত করেন শিক্ষকরা। কিন্তু শিক্ষককে অব্যাহতি দেওয়ার পদক্ষেপের ওপর স্থগিতাদেশ আসার আগ পর্যন্ত তারা ক্লাস ও পরীক্ষা ছাড়া চেয়ারম্যানের সঙ্গে কোনো মিটিং করবেন না বলে জানান। এর আগে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে টানা দুই সপ্তাহ একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত ছিলেন ওই ছয় শিক্ষক।

পরে ভুক্তভোগী শিক্ষক উপাচার্য, রেজিস্ট্রার ও বিভাগের চেয়ারম্যানকে বিবাদী করে উচ্চ আদালতে রিট করেন। গত ৪ এপ্রিল রিট পিটিশনের রায়ে বিভাগের একাডেমিক সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন আদালত। কিন্তু রায়ের পর পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও তা কার্যকর হয়নি।

এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে গত ৮ মে অধ্যাপক রেজাউল করিম চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে বলেন, আদালতের রায়ে আমি একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার যোগ্য। একই দিন উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও সিন্ডিকেট সদস্যদের ই-মেইলে আদালতের রায় কার্যকর করার অনুরোধ জানানো হয়।

 

এরই মধ্যে ড. রেজাউল করিম উপাচার্যের অফিস সূত্রে জানতে পারেন, এটি মনোবিজ্ঞান বিভাগের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে উপাচার্য কিছু করবেন না। অন্যদিকে, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এখতিয়ার বলে রায় কার্যকরে গড়িমসি করছেন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম বলেন, আমাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসানো হয়েছে। সিন্ডিকেটের তদন্ত ছাড়া যেখানে আমাকে শাস্তি দিতে পারে না, সেখানে চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরে আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্তদের বিচার চাওয়ায় আমাকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এমনকি হাইকোর্টের রায় আমার পক্ষে আসার পরও আমাকে শিক্ষাকার্যক্রম চালাতে দেওয়া হচ্ছে না। চেয়ারম্যান ও উপাচার্য একে-অপরের দিকে আঙুল তুলে দায় থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করছেন। কেউ আদালতের রায় কার্যকর করতে পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। চেয়ারম্যান উপাচার্যের নিজ এলাকার হওয়ায় তিনি (উপাচার্য) কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।

‘বর্তমান চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিনের পরই আমার চেয়ারম্যানশিপ। আমি যেন চেয়ারম্যান হতে না পারি সে লক্ষ্যে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। এক শিক্ষক আমার অধীনে পিএইচডি করতে চাইলে আদালতের রায় থাকা সত্ত্বেও সে সুযোগ দেওয়া হয়নি।’

আরও পড়ুন : কেন পারে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘অধ্যাপক রেজাউল করিম সকল প্রকার একাডেমিক কার্যক্রম থেকে নিষিদ্ধ, এমন নয়। গত চার মাসে তিনি তিনটি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কমিটিতে কাজ করেছেন। এর মধ্যে একটি কমিটিতে তিনি সভাপতিও ছিলেন। হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন, তারা তো আর বলে দেননি যে তাকে কোন কাজ দিতে হবে বা কোন কাজ দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও ঠিক করবে না। এটি একাডেমিক কাউন্সিলের কাজ।’

‘তাকে অতীতেও দুবার একাডেমিক কার্যক্রম থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তখন তিনি সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে পরিত্রাণ পেয়েছিলেন। সম্প্রতি তিনি ই-মেইলে সবাইকে ঢালাওভাবে খারাপ বলেছেন। তাহলে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই খারাপ? শুধু তিনিই ভালো! এ ছাড়া তিনি অন্য কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে মিটিংয়ে আসেন না। ভিন্ন সময় মিটিং দিতে বলেন, এটা কি সম্ভব?’

ড. রেজাউল করিমকে ক্লাসে কবে যুক্ত করা হবে– জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘এটি তো আমার একার সিদ্ধান্ত নয় যে আমি তাকে যুক্ত করব। এটি একাডেমিক কাউন্সিলের সার্বিক সিদ্ধান্ত। এ বিষয়ে আমাকে বলে লাভ নেই। সবাই যখন সিদ্ধান্ত নেবে তখনই এটি কার্যকর হবে।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রবীর কুমার সরকার বলেন, ‘বিষয়টি প্রক্রিয়ায় আছে। আশা করছি দ্রুত সমাধান হবে।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের সবাইকে আইন মেনে চলতে হবে। আইনের অনুশাসন অনুসরণ করতে হবে। আদালত যে রায় দিয়েছেন সেটি দ্রুত কার্যকর করা হবে।’

এসএসএইচ/এমএআর/