সিনিয়রের পোস্ট শেয়ার করায় মারধর
‘কাউকে জানালে শিবির ট্যাগ দিয়ে মেরে ঝুলিয়ে রাখব’
‘তুই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে পোস্ট শেয়ার দিছস ক্যান? কারণ... নিশ্চয়ই তুই শিবির করস।’ এমন নানা ধরনের প্রশ্নের পর মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে চেক করা হয়। পরে ফোনে কিছু না পেয়ে জেলে পাঠানোর হুমকি দেওয়া হয়। এছাড়া মোবাইলের বিকাশে থাকা টাকা কয়েকটি নম্বরে রিচার্জ করার পর এসব কথা কাউকে জানালে শিবির ট্যাগ দিয়ে মেরে ক্যাম্পাসের গেটে ঝুলিয়ে রাখার হুমকি দেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আক্তার হোসাইনের অনুসারীরা। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের রসায়ন বিভাগের ইব্রাহিম মাহমুদ জনি।
মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর নির্যাতনসহ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা অভিযোগ আকারে দায়ের করেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
অভিযোগপত্রে ইব্রাহিম উল্লেখ করেন, গত শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) দুপুর আড়াইটার দিকে ১৮তম ব্যাচের ওরিয়েন্টেশন উপলক্ষ্যে আমাদের বিভাগের সাজসজ্জার কাজ শেষ করে ক্যাম্পাস থেকে বের হচ্ছিলাম। এসময় অর্থনীতি বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ইকবাল মাহমুদ রানা এবং দর্শন বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মেহেদি আমার গতিরোধ করে। মাহমুদ রানা ও মেহেদী দুজনেই জবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী। তারা জানতে চায়, আমি কেন সৌরভ ভাইয়ের পোস্ট শেয়ার করেছিলাম? এর আগে ৩১ জুলাই ক্যাম্পাসে তিন ছাত্রলীগ কর্মী কয়েক দফায় সৌরভকে হামলা করে আহত করে। সৌরভ দাস রসায়ন বিভাগ ১৬তম আবর্তনের শিক্ষার্থী।
অভিযোগে ইব্রাহিম বলেন, সৌরভের ওপর এ হামলার প্রতিবাদে বিভাগের অন্য শিক্ষার্থীদের মতো সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দেই। এতে করে মেহেদী ও রানা এসে আমাকে শিবির বলে আখ্যা দেয়। এরপর তারা আমাকে মারধর করে। এমনকি আমার বাবা-মা ও টিউশনগুলোর অভিভাবকদের বাসায় ফোন দিয়ে বিকাশের মাধ্যমে টাকা আনার জন্য আমাকে বাধ্য করে। আমার বাবা-মা ও টিউশনের অভিভাবকদের কাছ থেকে ১৩ হাজার টাকা আনতে সক্ষম হই। এরপর আমাকে চড়-থাপ্পড় দিয়ে জোরপূর্বক আমার বিকাশ এবং নগদের পাসওয়ার্ড জেনে নেয় তারা। এরপর মেহেদি আমাকে ইকবাল মাহমুদ রানার সঙ্গে বসিয়ে রেখে আমার মোবাইল নিয়ে নেয়। তখন বিকাশের মাধ্যমে তিনটি আলাদা নম্বরে টাকাগুলো ফ্লেক্সিলোড করে নেয় তারা।
এসব ঘটনার বিষয় যদি কাউকে জানানো হয় তাহলে ইব্রাহিমকে শিবির ট্যাগ দিয়ে মেরে ক্যাম্পাসের মেইন গেইটে ঝুলিয়ে রাখবে বলে অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়। অভিযুক্ত রানা ও মেহেদী আরও বলেন, ‘তোর সিনিয়রকে (সৌরভ দাস, ১৬তম আবর্তন রসায়ন বিভাগ) যখন মারছিলাম... তখন নিউজ করা ছাড়া আর কিছু করতে পারস নাই। তোরা মানববন্ধন করতে আসার পরে তোদেরকে মানববন্ধন করতে দেই নাই।’
অভিযোগপত্রে ইব্রাহিম বলেন, ‘পরে তারা (রানা ও মেহেদী) আমাকে আবারও মারধর করে জোরপূর্বক ভিডিও ধারণ করেন। সেসময় তারা আমাকে বাধ্য করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে যে, আমি আগে শিবির করতাম আর এখন থেকে ছাত্রলীগ করব। পরিশেষে তারা বলেন, ‘তুই তো এইডা শেয়ার করবি সবার সাথে। তাই আমরা প্রুভ রাখলাম যে তুই শিবির। জানোসই তো, শিবির মারলে সব মাফ।’
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ইব্রাহিম মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, আমি যেন মুখ না খুলি এই ভয় দেখিয়ে শিবির করি এই মর্মে জোরপূর্বক ভিডিও করে রানা ও মেহেদী। তারা বলেছে আমি নাকি কোনো বিচার পাবো না, প্রক্টরও নাকি বিচার করবেন না। আরও অনেক হুমকি দিয়েছে। আমি ক্যাম্পাসে আমার নিরাপত্তা চাই।
এ বিষয়ে জবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস.এম আকতার হোসাইন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী ভুক্তভোগী হলে প্রক্টর অফিসে অভিযোগ দেবে। কোনো অপরাধের দায় ছাত্রলীগ নেবে না।
রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কালাম মো. লুৎফর রহমান বলেন, এমন ঘটনা কখনোই কাম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় নিয়ে আসুক। দোষীরা যে দলেরই হোক, তারা পার পেতে পারে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামাল বলেন, এ বিষয়ে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত করা হবে। দোষীদের ছাড় দেওয়া হবে না।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ইকবাল মাহমুদ রানা বলেন, সৌরভের বিষয়ে পোস্ট কেন শেয়ার দিয়েছিল, তা জানতে চেয়েছিলাম। সে (ইব্রাহিম) ভুল স্বীকার করে পোস্ট ডিলিট করে দিয়েছে। তাকে মারধর ও টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি।
এ ঘটনায় অভিযুক্ত মেহেদী বলেন, ওই ছেলেটি (ইব্রাহিম) নিজে স্বীকার করেছে যে, সে শিবির করে। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। তাকে মারধর ও টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল... এজন্য ফোনে ফ্লেক্সিলোড দিয়েছিল।
এমএল/কেএ