জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) শূন্য হওয়া বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আইন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা— কোনোটারই তোয়াক্কা করছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ব্যক্তিভেদে ঘটছে নিয়মের ভিন্নতাও!

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পদে বর্তমান কর্মকর্তার চাকরির মেয়াদ আরও সপ্তাহখানেক থাকলেও ওই পদে আবারও এক বছরের জন্য তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এমন অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ও ভুক্তভোগী কর্মকর্তারা।

জানা যায়, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, পরিচালক (অর্থ ও হিসাব), পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন)-সহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো চলতি দায়িত্ব বা অতিরিক্ত দায়িত্ব না দিয়ে পূর্ণকালীন নিয়োগ দিতে গত বছরের ২০ মার্চ একটি নির্দেশনা জারি করে। কিন্তু ওই নির্দেশনা উপেক্ষা করে অর্থ পরিচালক, রেজিস্ট্রার, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পরিচালক পদে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অতিরিক্ত দায়িত্ব বা চলতি দায়িত্ব দিয়ে পূর্বের জনকে স্বপদে বহাল রেখেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, পরিচালক (অর্থ ও হিসাব), পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন)-সহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো চলতি দায়িত্ব বা অতিরিক্ত দায়িত্ব না দিয়ে পূর্ণকালীন নিয়োগ দিতে গত বছরের ২০ মার্চ একটি নির্দেশনা জারি করে। কিন্তু ওই নির্দেশনা উপেক্ষা করে অর্থ পরিচালক, রেজিস্ট্রার, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পরিচালক পদে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অতিরিক্ত দায়িত্ব বা চলতি দায়িত্ব দিয়ে পূর্বের জনকে স্বপদে বহাল রেখেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা অমান্য করে এমন নিয়োগের বিষয়ে ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, ‘নিয়ম হলো যদি পদ খালি হয় তবে বিজ্ঞাপন দিতে হবে দুবার। একবার না পাওয়া গেলে দ্বিতীয়বার দিতে হবে। দ্বিতীয়বারেও না পাওয়া গেলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে লিখতে হবে যে আমরা যোগ্য কাউকে পাচ্ছি না। আমরা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে চাচ্ছি। তখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেবে। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তাই অবসরের পরে রেজিস্ট্রারকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সিদ্ধান্ত মূলত নিয়মের ব্যত্যয়।’

অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. আখতারুজ্জামানের বিষয়ে ইউজিসির নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রতিপালন করা হয়েছে। যদিও আখতারুজ্জামান অবসরোত্তর ছুটি স্থগিত-সাপেক্ষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে ইচ্ছুক ছিলেন।

এ বিষয়ে আখতারুজ্জামান বলেন, ‘মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে উপাচার্য স্যারকে বলেছিলাম যে অবসরোত্তর ছুটি স্থগিত রেখে আমাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যায় কি না। কোষাধ্যক্ষ, রেজিস্ট্রার সবার সামনে তিনি বলেন, ইউজিসি থেকে নিষেধাজ্ঞা আছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যাবে না। কিন্তু রেজিস্ট্রারকে ঠিকই একইভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হলো। ব্যক্তিবিশেষ একই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই নীতি দেখলাম। রেজিস্ট্রার নিয়োগে কি ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা ছিল না? উপাচার্য চাইছেন বলে রেজিস্ট্রারকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলেন। তাহলে আমাকে কেন দিলেন না?’ 

এর আগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত করা হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক অধ্যাপক ড. আনোয়ারা বেগমকে। চাকরির মূল বয়স শেষ হলেও বীর মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এক বছর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে পারতেন তিনি। বাংলাদেশ সরকারের এমন সিদ্ধান্ত থাকলেও বঞ্চিত করা হয় তাকে।

এ বিষয়ে ড. আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে রাষ্ট্র আমাকে যে সম্মান দিয়েছিল তাতে আমি আরও এক বছর চাকরির সুযোগ পেতাম। কিন্তু আমাকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান আমাকে সুযোগ দেননি। আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অন্যান্য জায়গায় সব শিক্ষক এ সুবিধা পান কিন্তু একটা বিশেষ মহলের সুবিধার্থে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ক্যাম্পাস / ফাইল ছবি

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, এসব অতিরিক্ত বা চলতি দায়িত্বের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যত্যয় ঘটেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনেও। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংবিধির বাছাই বোর্ড ৫ ধারার ৯ উপবিধিতে বলা হয়েছে, ‘সিন্ডিকেটের পূর্বানুমানমূলকক্রমে ভাইস চ্যান্সেলর সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধান বা শাখা প্রধানের সুপারিশের ভিত্তিতে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক বা শাখা প্রধানের পদ ব্যতীত অন্যান্য পদের ক্ষেত্রে সাধারণত অনূর্ধ্ব ছয় মাসের জন্য অস্থায়ী নিয়োগ দিতে পারবেন।’ কিন্তু এ আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে উপাচার্য রেজিস্ট্রার পদে আগের ব্যক্তিকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছেন— দাবি সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও কর্মকর্তার।

জানা যায়, চুক্তিভিত্তিক রেজিস্ট্রার নিয়োগে হয়নি কোনো সিন্ডিকেট মিটিং। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য এবং বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হোসনে আরা জলি। ব্যক্তিভেদে নিয়মের ভিন্নতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিও।

এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম বলেন, ‘অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে কেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে হবে? আমরা উপাচার্যকে নিষেধ করেছিলাম। কিছু মানুষের সুবিধার জন্য তাদের প্ররোচনায় নিয়ম না মেনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়োগে ৭০০ জন শিক্ষকের কোনো পরামর্শ নেওয়া হয়নি। ইউজিসির নির্দেশনাও মানা হলো না।’

অন্যদিকে, রেজিস্ট্রারের পুনর্নিয়োগের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে হয়নি বলে দাবি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তা। তাদের মতে, এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অবৈধভাবে হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, রেজিস্ট্রার স্যার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন আছেন। সব পথ তার চেনা। তিনি থাকলে কিছু মানুষ ফায়দা লুটতে পারবেন। সামনে অনেক নিয়োগ। এজন্য সব নিয়ম ভেঙে তাকে পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ও ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামালউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থেই রেজিস্ট্রারকে পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়ম মেনেই সবকিছু হয়েছে।’

এমএল/এফকে