চৌর্যবৃত্তি প্রতিরোধে ঢাবির নীতিমালা, ইতিবাচক বলছেন শিক্ষক নেতারা
গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি প্রতিরোধে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কর্তৃপক্ষ। গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির জন্য জরিমানা, পদাবনতি, ডিগ্রি বাতিল থেকে চাকরিচ্যুতির মতো শাস্তির মুখে পড়তে হবে দায়ী শিক্ষক-গবেষকদের। এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতারা।
সোমবার (২৩ জুন) অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় অনুমোদনের জন্য উঠে ‘দ্য রুলস ফর দ্য প্রিভেনশন অব প্লেইজারিজম’ শীর্ষক নীতিমালাটি। সভায় নীতিগতভাবে নীতিমালাটি গৃহীত হলেও তা সংশোধন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের জন্য দুই সপ্তাহ সময় নিয়েছে একাডেমিক কাউন্সিল। এরপর সিন্ডিকেটে চূড়ান্ত অনুমোদন হবে এই নীতিমালা।
বিজ্ঞাপন
নীতিমালায় গবেষণায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত সামঞ্জস্যকে ‘গ্রহণযোগ্য’ (লেভেল-০) বলা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে একক উৎস থেকে সর্বোচ্চ ২ শতাংশের বেশি তথ্য ব্যবহার করা যাবে না। নীতিমালায় অন্য মাত্রাগুলো হলো— নিম্ন (লেভেল-১), মধ্য (লেভেল-২), উচ্চ (লেভেল-৩) ও পুনরাবৃত্তি (লেভেল-৪)। গবেষণায় ২০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত সামঞ্জস্য নিম্ন, ৪০-৬০ শতাংশ মধ্য এবং ৬০ শতাংশের বেশি সামঞ্জস্য উচ্চমাত্রার সামঞ্জস্য হিসেবে গণ্য হবে।
নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, ২০ শতাংশ পর্যন্ত সামঞ্জস্যের ক্ষেত্রে কোনো শাস্তির মুখে পড়তে হবে না। তবে একই উৎস বা সূত্র থেকে ২ শতাংশের বেশি তথ্য ব্যবহার করা হলে তা নিম্নমাত্রার সামঞ্জস্যের (লেভেল-১) আওতায় পড়বে।
নীতিমালা অনুযায়ী, লেভেল-১-এর অপরাধ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বা ক্রেডিট ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে লেখক বা গবেষককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা দেওয়া সাপেক্ষে পাণ্ডুলিপি সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হবে। ওই সময়েও সংশোধনে ব্যর্থ হলে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা দেওয়া সাপেক্ষে আরও ছয় মাস সময় দেওয়া হবে। দ্বিতীয় পর্যায়েও সংশোধনে ব্যর্থ হলে লেখক বা গবেষকের ওই ডিগ্রি বা কোর্স বাতিল বা প্রত্যাহার করা হবে।
লেভেল-২-এর অপরাধ প্রমাণিত হলে দায়ী ব্যক্তি ২০ হাজার টাকা জরিমানা সাপেক্ষে পাণ্ডুলিপি সংশোধনে এক বছর সময় পাবেন। এসময়ে সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বা ক্রেডিট স্থগিত থাকবে। ওই সময়ের মধ্যে পাণ্ডুলিপি সংশোধনে ব্যর্থ হলে আরও ২০ হাজার টাকা জরিমানা সাপেক্ষে অতিরিক্ত ছয় মাস সময় দেওয়া হবে। পুরো সময় পর ওই ডিগ্রি বা কোর্সটি বাতিল করা হবে। দায়ী ব্যক্তি নকল ডিগ্রির মাধ্যমে নিয়োগ-পদোন্নতি বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট সময়ে পাওয়া সব টাকা অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে ফেরত নেওয়া হবে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বাতিলের পাশাপাশি এক ধাপ পদাবনতি ও চার বছরের জন্য পদোন্নতি বন্ধের শাস্তি হবে তার।
লেভেল-৩-এর অপরাধ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বা কোর্স দুই বছরের জন্য স্থগিত করে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা সাপেক্ষে পাণ্ডুলিপি সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হবে। নির্ধারিত সময়ে সংশোধনে ব্যর্থ হলে ওই ডিগ্রি বাতিল ও কোর্সটি অনুত্তীর্ণ (এফ গ্রেড) বলে গণ্য হবে। অপরাধী ব্যক্তি নকল ডিগ্রির মাধ্যমে নিয়োগ-পদোন্নতি বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট সময়ে পাওয়া সব টাকা অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে ফেরত নেওয়া হবে। একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বাতিলের পাশাপাশি এক ধাপ পদাবনতি ও ছয় বছরের জন্য পদোন্নতি বন্ধের শাস্তি হবে তার। কোনো ব্যক্তি লেভেল-৩-এর অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে সেই অপরাধকে লেভেল-৪ এর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত করা হবে।
চৌর্যবৃত্তি প্রতিরোধে নেওয়া সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতারা। তারা বলছেন, গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি প্রতিরোধে এটি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণার মান বাড়বে এবং র্যাংকিংয়ে প্রভাব পড়বে। এই নীতিমালার বস্তুনিষ্ঠ প্রয়োগ চান শিক্ষক নেতারা।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, গবেষণার ক্ষেত্রে প্লেইজারিজম কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গৃহীত এই নীতিমালা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সর্বসম্মতিতে গ্রহণ করেছেন। আমরা যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংকে ভালো অবস্থানে নিতে চাই, সেহেতু এই ব্যাপারে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সচেতন এবং এই নীতিমালার পক্ষে। সংযোজন-বিয়োজন করে হলেও নীতিমালা চূড়ান্ত রূপ পাক এটা আমরা চাই।
সমিতির সহ সভাপতি অধ্যাপক লুৎফর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই নীতিমালাকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। বিশ্ব এখন এগিয়ে যাচ্ছে, গবেষণা তো বটেই সব ক্ষেত্রেই প্লেইজারিজমমুক্ত থাকা উচিত। একাডেমিক কাউন্সিলে শিক্ষকরা কিছু মতামত দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আরও দুই সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েই এটি চূড়ান্ত রূপ লাভ করবে বলে আমি আশাবাদী।
শিক্ষক সমিতির সদস্য ও সিনেট সদস্য অধ্যাপক ড. এ জে এম শফিউল আলম ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, চৌর্যবৃত্তি প্রতিরোধে করা এই নীতিমালাকে আমরা স্বাগত জানাই। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটিকে রোধ করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রথমবারের মতো লিখিতভাবে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। আমরা আশা করব এই নীতিমালাটি যখন চূড়ান্ত হবে তখন বস্তুনিষ্ঠভাবে এটি পালন হবে। এই নীতিমালার উদ্দেশ্য কিন্তু কাউকে শাস্তি দেওয়া নয়, উদ্দেশ্য হচ্ছে এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে প্রতিরোধ করা, প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করা। কাউকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এই নীতিমালা করা হয়নি।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, গবেষণার মৌলিকত্বকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেওয়ার জন্যই এই নীতিমালা করা হয়েছে। শাস্তি বিধান করাই এই নীতিমালার মূল উদ্দেশ্য নয়। বরং সচেতনতা বৃদ্ধি, চৌর্যবৃত্তি প্রতিরোধ এবং গবেষণার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি করতেই এটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে বিভিন্ন বিধান এবং সংশোধনের সুযোগ রাখা হয়েছে। এরপরও কেউ যদি চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নেয় তাহলে তার চৌর্যবৃত্তির সামঞ্জস্যতার ওপর ভিত্তি করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি কেউ একাধিকবার এর আশ্রয় নেয় তাহলে চাকরিচ্যুতি পর্যন্ত হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে এবং নীতিমালায় সংশোধন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের জন্য দুই সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষকদের মতামত চাওয়া হয়েছে। মতামতের ওপর ভিত্তি করে তা আগামী ডিনস কমিটিতে উত্থাপন করা হবে। এরপর তা সিন্ডিকেটে চূড়ান্ত অনুমোদন পাবে। চৌর্যবৃত্তি রোধে গবেষণায় উদ্ধৃতির ব্যবহার, চৌর্যবৃত্তি শনাক্তের সফটওয়্যার ও টুলসের ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের কর্মশালার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
এইচআর/এসএসএইচ/