ক্ষণজন্মা ড. ফারুক হোসাইন
আমাদের সমাজব্যবস্থায় একজন শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে বিবেচিত। এমন মানুষ গড়ার কারিগরদের একটি প্রজ্জলিত নক্ষত্রের সঙ্গে তুলনা করলে খুব বেশি করা হবে না, বরং কমই হবে। ড. ফারুক হোসাইন স্যারও ছিলেন তেমনই এক নক্ষত্রতুল্য মানুষ। নক্ষত্র যেমন আলো বিকিরণ করে তার সৌরজগতকে জিইয়ে রাখে, তেমন করে একজন শিক্ষকও জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে জাতিকে সঠিক পথে পরিচালনা করে। জ্ঞান বিস্তারের কারিগরদের মধ্যেও কিছু অগ্রপথিক থাকেন। ফারুক হোসাইন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন।
ব্যক্তিগত, সামাজিক কিংবা শিক্ষকতা জীবনে এমন একজন মানুষ বর্তমানে খুঁজে পাওয়া বিরল। শুধু সমাজকর্ম বিভাগেরই নন, তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদেরও ভালোবাসার পাত্র। দল, মত নির্বিশেষে সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য। একটি মানুষের জীবনের এটাই হয়তো অন্যতম সফলতা। সব মতের মানুষের ভালোবাসার পাত্র হওয়া সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। সবাইকে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে ভালোবাসাও হয়তো সম্ভব নয়। মতাদর্শের বলয়ে আবদ্ধ হয়ে যায় ভালোবাসা। যা ফারুক হোসাইন স্যারের ক্ষেত্রে বিপরীত হয়েছে। প্রাপ্তির খাতায় আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কী পেয়েছেন তা অজানা থাকলেও, কী দিয়ে গেছেন তা কিন্তু কারোরই অজানা নয়। দুই হাত ভরে স্নেহ মমতা দিয়ে গেলেন আমাদের। ডেকে ডেকে ভালোবাসা বিলিয়ে গেলেন। একজন কিংবদন্তীর পথচলা বুঝি এমনই হয়!
বিজ্ঞাপন
পৃথিবী থাকার জায়গা নয়। এটা চিরন্তন সত্য। মৃত্যুকে বরণ করার মাঝেই জীবনের সফলতা। মৃত্যুর পরও অমর হওয়ার মাঝে জীবনের স্বার্থকতা। ফারুক হোসাইন স্যার সারাজীবন যেন সেই স্বার্থকতাই খুঁজেছেন। কথায়, কাজে, চিন্তায়, মননে সবিনয়ে অতিবাহিত করেছেন জীবনের প্রাপ্য দিনগুলো। এ জীবন আমাদের ইচ্ছেমতো চলে না। চলার কথাও না। জীবন আমরা সৃষ্টি করিনি। যতদূর মনে পড়ে বিভিন্ন ক্লাসে ও ক্লাস পরবর্তী একান্তই সাক্ষাতে যখন এ মানুষটির সঙ্গে কথা হতো তখন কেবলই আরেকটু বাঁচতে চাইতেন। সবার ভালোবাসার বিপরীতে আরেকটু বেশি সময় ধরে এ পৃথিবীর শ্বাস নিতে চাইতেন। দুরারোগ্য ব্যাধি শরীরের ভেতরটা খানখান করে দিলেও বাহিরটা কখনোই টলাতে পারেনি। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এ মানুষটি লড়ে গেছেন। নিজ শরীরের সঙ্গে মনের অন্তর্দ্বন্দ্বে স্বঘোষিত ৪৯ বছরের কিশোর ফারুক হোসাইন অবশেষে হারলেন। নিয়তির বেড়াজালে আটকে পড়লেন। সেদিন মন হেরে গেছে ঠিকই, কিন্তু হেরে গিয়েও জিতিয়ে দিয়েছে পুরো ফারুক হোসাইন নামক সত্তাকে। এমন হার-ই বা ক'জনের ভাগ্যে জোটে?
স্যারের সঙ্গে পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিন ২১ জানুয়ারি, ২০২০ থেকেই। ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠান শেষে সমাজকর্ম বিভাগের ১৫৬ নাম্বার রুমের সামনে আমিসহ আরো দু'জন দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ একটা ভাই এসে ডাক দিলো যে তোমাদের সঙ্গে আমাদের একজন স্যার কথা বলতে চান, চেম্বারে চলো। ওই ভাইয়ের সঙ্গে চেম্বারে চললাম। আমাকে সামনে দাঁড় করালো আর আমার সঙ্গের বাকি দু'জনকে পরিচয় জিজ্ঞেস করা শুরু করলো। স্যারের কথা বলার বাচনভঙ্গি আর প্রশ্ন করা দেখে মনে মনে একটু ভয় পেলাম। পরক্ষণে যখন আমাকে প্রশ্ন করা শুরু করলেন তখন যেন সে অজানা ভয় নিমিষেই কেটে গেলো। ওইদিন থেকেই এক অন্যরকম মানুষ হিসেবে স্যারকে আবিষ্কার করি। করোনার মধ্যবর্তী সময়ে রাজশাহীতে অবস্থান করার সুযোগ হয়েছিলো। সেই সুবাদে প্রায়ই স্যারের সঙ্গে দেখা হতো। ব্যক্তিগতভাবে এমন কোনো কথা ছিলো না যা স্যারের কাছে বলতে সংকোচবোধ করতাম। স্যার প্রায়ই বলতেন, 'যে কথা ফারুক হোসাইনকে বলতে পারবে না, মনে রাখবা সে কথা আর কারো কাছেই বলতে পারবে না।'
ফারুক স্যার ছাড়া জীবদ্দশায় মানুষকে মনোযোগ দিয়ে শোনার মতো দ্বিতীয় কোনো মানুষকে এখনো দেখতে পাইনি। মৃত্যুর কিছুদিন আগে এত অসুস্থতার মধ্যেও পরীক্ষা শেষে খোঁজ নিতে ভুলে যাননি। একটু সুস্থতা অনুভব করলে কথা বলবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। স্যারের সে কথাটি মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করে নিয়েছিলাম। তখনও বিশ্বাস হতে চাইতো না যে মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে এ মানুষটি আমাদের সবার অশ্রুর বারিধারা হবেন। সৃষ্টি করবেন পাহাড় সমান শূন্যতা।
শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। মহান মানুষেরাই এ পেশাকে আবাদ করে আসছেন। তবে এর মধ্যে ক'জনই বা ভালোবেসে এ পেশাকে আঁকড়ে ধরেন? নিশ্চয়ই হাতেগোনা কিছু মানুষই হবেন। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ড. ফারুক হোসাইন। ভালোবেসে শিক্ষকতা পেশাকে নিয়ে গিয়েছেন অনন্য মাত্রায়। বাঁচতে চেয়েছেন তার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে। স্নেহ, মায়া, মমতার বাঁধনে বেঁধেছেন সব শুভাকাঙ্ক্ষীকে। যার মধ্যে বাদ পড়েননি কেউই। ছাত্র-ছাত্রী, সহকর্মী, বন্ধু, পরিবার সবারই এক আশার আলো ছিলেন ড. ফারুক হোসাইন। মৃত্যু শেষে কেউ কেউ এমন করে মন্তব্য করেছিলেন যে ফারুকের মৃত্যু হলো ঈর্ষান্বিত মৃত্যু। যা সবার ভাগ্যে লেখা থাকে না।
সর্বশক্তিমান রব আমাদেরকে এ জীবন উপহার দিয়েছেন। পৃথিবীর মানুষের জন্য কিছু করা, নিজের পরবর্তী জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করা আর মানুষকে ভালোবাসার জন্যই আমাদেরকে এ ধরায় পাঠিয়েছেন।
মৃত্যুই তো জীবনের অন্য নাম। মহাগ্রন্থও বলে প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। পারতপক্ষে এর থেকে বাঁচার কোনো উপায় নাই। সেই মৃত্যু যদি হয় মহাত্মা ফারুক হোসাইন এর মতো তাহলে মরেও অমর হওয়া যায়। প্রশান্ত আত্মাদের দলে নিজেকে শরীক করা যায়। ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর, বেদনাবিধুর লগ্ন থেকে ব্যক্তি ফারুক হোসাইন পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু আত্মিক ফারুক হোসাইন স্ব-গৌরবে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের মাঝেই তো বেঁচে আছেন আত্মিক ফারুক হোসাইন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ মহান মানুষটিকে তার রহমতের চাদরে মুড়িয়ে রাখুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
জেডএস