মঙ্গলবার বিকেলে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলে তাদের ওপর চড়াও হন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা

প্রায় ১৪ বছর একটানা ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। ফলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একক আধিপত্য। আর এতে ‘ক্যাম্পাসে সহাবস্থান’ বলতে যা ছিল তা একেবারেই হারিয়ে যাচ্ছে। 

আওয়ামী লীগের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের উল্লেখযোগ্য কোনো তৎপরতা নেই কোথাও। কখনও কখনও তারা স্রেফ নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়ার চেষ্টা করলেও রুখে দাঁড়াচ্ছে ছাত্রলীগ। মূলত বাম ছাত্র সংগঠনগুলোই এখনও ক্যাম্পাসে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন-বিক্ষোভ-কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে তারা।   

সার্বিক পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে- ছাত্রলীগের দাপটে রাজনৈতিক সহাবস্থান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সর্বশেষ গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার চেষ্টা করে হামলার শিকার হয়েছে ছাত্রদল।  

এ বছর আরও দু’বার ক্যাম্পাসে ঢুকতে চেয়ে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয় ছাত্রদল।

গত বছরের অক্টোবরে ১৮ মাস পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে পা রাখে ছাত্রদল। মধুর ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে সেদিন ক্যাম্পাসে মিছিলও করে ছাত্রদল। তবে সেদিনও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সরব অবস্থান ছিল ক্যাম্পাসে। 

গত মাসে ছাত্র অধিকার পরিষদের দুই নেতাকে মারধর করে পরে ক্ষমা চান ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী।  

আরও পড়ুন : মাথা ফেটেছে ছাত্রদল সভাপতির, হাত ভেঙেছে সম্পাদকের

দলীয় প্রতিপক্ষকে নানাভাবে দমন-পীড়ন ছাড়াও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপরও নানা নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে গেস্টরুম নির্যাতনের শিকার হতে হয় শিক্ষার্থীদের। প্রকাশ্যে ভিন্ন মতের রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে হলে থাকতে পারার নজির এখন নেই বললেই চলে। 

গত মঙ্গলবার ছাত্রদলের নেতাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসার খবরে মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা

উদ্ভূত এ পরিস্থিতির জন্য প্রশাসনের শক্ত ভূমিকা না থাকাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

হলগুলোতে প্রশাসনের ভূমিকায় ছাত্রলীগ 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলগুলো পরিচালনার জন্য হল প্রশাসন থাকলেও বাস্তবে হলের নিয়ন্ত্রণ তাদের কাছে থাকে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের হল নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও নবীন শিক্ষার্থীদের হলে তোলা, ছাত্রদের বিভিন্ন হলের কোন কক্ষে কে থাকবেন, তা নিয়ন্ত্রণ করে মূলত ছাত্রলীগ। 

আরও পড়ুন : গেস্টরুম যেন ছাত্রলীগের ‘টর্চার সেল’!

ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে প্রোগ্রাম ও গেস্টরুমে অংশ নিয়ে তবেই হলে থাকার সুযোগ হয় শিক্ষার্থীদের। ছাত্রলীগ আরোপিত নিয়মনীতি না মানলে গেস্টরুম নির্যাতনের শিকার হতে হয় শিক্ষার্থীদের। হলও ছাড়তে হয়েছে অনেক শিক্ষার্থীকে। চলতি বছর এমন অন্তত ৫টি ঘটনা ঘটেছে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে শিপন মিয়া নামে এক শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনদিন বাইরে থেকে পরে মীমাংসার মাধ্যমে হলে ওঠেন। বঙ্গবন্ধু হলের আবু তালিব নামে এক শিক্ষার্থী ছয় মাসেরও বেশি সময় আছেন হলের বাইরে।

আগস্ট মাসে ভিন্নমতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল ও জসিম উদ্দিন হলের দুই শিক্ষার্থীকে হল প্রশাসনের হাতে তুলে দেয় ছাত্রলীগ। তাদের মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মিফতাহুল মারুফ নামের একজনকে প্রায় ১৫ ঘণ্টা শাহবাগ থানায় আটকে রাখা হয়। এছাড়া জসিম উদ্দিন হলের এক শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়।

এছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যঙ্গাত্মক পোস্ট দেওয়ায় মুহসীন হল থেকে এক ছাত্রকে হলছাড়া করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি স্যার এ এফ রহমান হল ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে সিভি জমা না দেওয়ায় হল থেকে বের করে দেওয়া হয় আমান উল্লাহ নামে এক শিক্ষার্থীকে। হল ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে হল সভাপতি রিয়াজুল ইসলামের অনুসারী সামিউজ্জামান সামি বন্দুকের ভয় দেখিয়ে এই শিক্ষার্থীকে বের করে দেন।

নিজেরাও জড়ান বিরোধে 
এক নবীন শিক্ষার্থীকে হলে তোলা নিয়ে গত  ৮ সেপ্টেম্বর মুহসীন হল ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। নবীন শিক্ষার্থী তোলার সময় ছেলেদের প্রায় প্রত্যেক হলে এমন ঘটনা ঘটে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। এছাড়া কক্ষ নিয়ন্ত্রণ ও ভাগাভাগি নিয়ে হলগুলোতে প্রায়ই বিরোধে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পক্ষ। তবে হল প্রশাসন বলছে, হলে তোলা কিংবা আবাসিক কক্ষ বণ্টন করার দায়িত্ব প্রশাসনের। এ দায়িত্ব কোনো সংগঠনকে দেওয়া হয়নি।

হলে থাকতে হলে মানতে হয় ছাত্রলীগের নির্দেশনা 
হলে থাকতে শিক্ষার্থীদের জন্য এখন নির্দেশনাও জারি করছে ছাত্রলীগ। সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে এমন কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়।নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- হলের ভেতরে এবং বাইরে ‘বড় ভাইদের’ সালাম দিতে হবে। সালাম দেওয়ার সময় ডান হাত দিয়ে হ্যান্ডশেক করতে হবে, বাম হাত পেছনে রাখতে হবে। এ সময় বড় ভাইদের হাতে ঝাঁকি বা চাপ দেওয়া যাবে না। ছাত্রলীগের সকল প্রোগ্রামে নিয়মিত অংশ নিতে হবে। হলে থেকে ছাত্রলীগ ব্যতীত অন্য কোনো রাজনৈতিক সংগঠন যেমন- ছাত্রদল, ছাত্রশিবির এবং বাম সংগঠন করা যাবে না। ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো সংগঠন করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হলের যেকোনো ব্যাপারে ‘ইমিডিয়েট বড় ভাইদের’ সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

এ নির্দেশনাগুলোর বাইরেও শিক্ষার্থীদের আরও কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। যেগুলো না মানলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

যদিও হলে ওঠার সময় হল কর্তৃপক্ষের দেওয়া নির্দেশনামায় এ ধরনের কোনো নিয়ম নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশেও নেই এ ধরনের কোনো নির্দেশনা। 

আরও পড়ুন : ছাত্রলীগ সভাপতি বললেন ছাত্রদল নিজেরাই মারামারি করেছে

ছাত্রলীগের হামলায় ছাত্রদলের অন্তত ১০ জন নেতাকর্মী আহত হন

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জিয়াউর রহমান হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, গেস্টরুমে বড় ভাইয়েরা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বোকা বানানোর জন্য অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন করে। অনেক সময় নানান অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি নিজেরাও করে, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদেরও করতে বাধ্য করে। পান থেকে চুন খসলেই নানাভাবে অপমান-নির্যাতন করা হয়।

এসব প্যাঁচে পড়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও বছর ঘুরতেই সে স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায় বহু শিক্ষার্থীর। প্রোগ্রাম, গেস্টরুম, নিয়মনীতি মেনে চলতে চলতে পড়াশোনার সময় পাওয়া যায় খুব সামান্য। ভিন্ন একটা সংস্কৃতিতে খাপ খাওয়াতে না পেরে অনেকে হারিয়ে ফেলেন দিশা। যে শিক্ষার্থী সবসময় স্কুল কলেজের ‘ফার্স্ট’ বয় ছিল, সে শিক্ষার্থী থাকেন ইয়ারড্রপের শঙ্কায়, অনেকেই জড়িয়ে পড়েন মাদকে।  

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিভিন্ন প্রোগ্রামের পাশাপাশি সপ্তাহে অন্তত তিনদিন ছাত্রলীগের ডাকা গেস্টরুমে অংশ নিতে হয় তাদের। অংশ না নিলে তাদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন। গেস্টরুমেও তাদের ওপর চলে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। সব কিছু করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যারা পারিবারিকভাবে স্বচ্ছল তারা বাসা বা মেসে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যান।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত মাসে (আগস্ট) প্রায় ২৫ দিনই ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে অংশ নিতে হয়েছে। একইসঙ্গে পরীক্ষাও চলছিল। পাশাপাশি চলেছে গেস্টরুমও। পড়াশোনার সময় কিংবা পরিবেশ কোনোটাই পাইনি। তাই ফলাফল যেমন হওয়ার তেমনই হয়েছে। পাস করব কি না জানি না।  ভর্তি হওয়ার পর থেকেই এভাবে চলছে। অথচ অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাবিতে ভর্তি হয়েছিলাম।  

ছাত্র নেতারা যা বলছেন 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক খোরশেদ আলম সোহেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নিশ্চিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে প্রশাসন। আমরা প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করব আপনারা শুধু ছাত্রলীগের না হয়ে, সকল ছাত্রের অভিভাবক হন, ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নিশ্চিত করুন।

ছাত্র ইউনিয়ন ঢাবি সংসদের আহ্বায়ক কাজী রাকিব হোসাইন বলেন, ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভিন্ন মত দমনে আওয়ামী লীগ সরকারের লাঠিয়াল বাহিনীর ভূমিকা পালন করছে। শিক্ষার্থীদের মেরে হল থেকে বের করে দেওয়া, পুলিশের হাতে তুলে দেওয়াসহ নানাবিধ ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ। সব ক্ষেত্রেই প্রশাসনের নীরব ভূমিকা আমরা দেখে এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক সহাবস্থান নিশ্চিত করা প্রশাসনের কর্তব্য। কিন্তু বিগত সময়ে ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী এবং শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আগামী দিনে গণতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণে শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির কোনো বিকল্প নেই। 

মে মাসেও ছাত্রলীগের হামলার শিকায় হয় ছাত্রদল

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সুহাইল আহমেদ শুভ বলেন, ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মসূচি করার। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা ভিন্ন মত দমনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের অব্যাহত আক্রমণের ঘটনা বাড়িয়েই তুলছে। বিভিন্ন সময়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টসহ অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছেন। হলগুলোতে দখলদারিত্ব বজায় রেখে গেস্টরুম-গণরুমে শিক্ষার্থী নির্যাতন, ভিন্নমত দমন, চাঁদাবাজি, হামলা, গেস্টরুম, নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা হল-ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও সহাবস্থান নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।

সহাবস্থান ফেরাতে ছাত্রসংসদ কার্যকরের দাবি 
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রসংসদ কার্যকরী হলেই ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য কমবে কি না এ প্রশ্ন পুরোনো। তারপরও ছাত্রনেতাদের মধ্যে থেকে এ দাবি উঠছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রদের নিরাপত্তার ব্যাপারে শুধু উদাসীনই নয়, বরং ছাত্রলীগের অপকর্মের প্রশ্রয় দেয় বলেই এসব ঘটনার প্রতীয়মান হয়। ডাকসু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরি হতে শুরু করেছিল, কিন্তু আবারও সেই পূর্বের বদ্ধ পরিবেশ ফিরে এসেছে। আমরা চাই যে প্রশাসন ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন করে সহাবস্থান এবং শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে। 

আরও পড়ুন : ঢাবিতে ছাত্রলীগের হামলায় ছাত্রদলের ১০ নেতাকর্মী আহত

ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দখলদারিত্ব বজায় রাখতেই ডাকসু নির্বাচন থেকে বিরত থাকছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে কিছুটা হলেও সহাবস্থান ফিরে এসেছিল। ক্যাম্পাসের বর্তমান পরিস্থিতি আবার খারাপের দিকেই যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে তারা ডাকসু নির্বাচনে মাধ্যমে ক্যাম্পাসে সহাবস্থান ফেরাতে পারে। 

ডাকসুর সাবেক জিএস গোলাম রাব্বানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্যাম্পাসে একসময় সুন্দর সহাবস্থান বজায় ছিল। ছাত্রদলকে আমিই ফুল দিয়ে মধুর ক্যান্টিনে বরণ করে নিয়েছিলাম। সহাবস্থান নিশ্চিতের জন্য ডাকসু জরুরি। কেননা, ডাকসুতে যারা আসবে তারা নির্দিষ্ট কোনো সংগঠনের নয়, তারা সবার প্রতিনিধি। তখন সামগ্রিক সহাবস্থান ও সুন্দর পরিবেশ বজায় থাকবে। আমরা চাই ক্যাম্পাসে সবাই রাজনীতি করুক, আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীও এটা চান। অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ডাকসু নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানাই।  বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলে আমরা যেকোনো সময় সহযোগিতা করতে রাজি আছি।

একই সুর ছাত্রলীগ-প্রশাসনে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, একটি ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসী আচরণের দায় অন্য সংগঠন গ্রহণ নিতে পারে না। ছাত্রদলের সন্ত্রাসী আচরণের দায় ছাত্র রাজনীতি বহন করবে না। কেউ যদি বলে যে ছাত্র রাজনীতিতে সহাবস্থান নেই আমি মনে করি তারা সঠিক বলছে না। কারণ এখানে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, সম্মেলন করছে, কমিটি দিচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা করছে। সুতরাং এটা বলার ন্যুনতম সুযোগ নেই যে বিশ্ববিদ্যালয় গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। 

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি তিলোত্তমা শিকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছাত্রলীগ সবসময় সহাবস্থানের পক্ষে। এই ক্যাম্পাসে সবসময় সেটি বজায় ছিল। কিন্তু যখন তারা পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে ওঠার কথা বলে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কথা বলে, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কথা বলে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীই প্রতিবাদ জানাবে, এটাই স্বাভাবিক। ছাত্রলীগের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের অবস্থান দেখে কেউ যদি পালিয়ে যায় সে দায়ভার তো ছাত্রলীগ নেবে না। শুধুমাত্র অছাত্রদের নিয়ে অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারাকে সহাবস্থান বলে না। শিক্ষার্থীদের জন্য তারা কিছুই করে না, কিন্তু ছাত্রলীগ সবসময় শিক্ষার্থীদের পাশে থাকে। সহাবস্থানের কথা যদি বলি শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতাই নেই, অবস্থান কিভাবে থাকবে।  

ইডেন কলেজে সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগেরই দুই পক্ষ 

ছাত্রলীগের মতো একই সুরে কথা বলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তারা বলছে- দুয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলেও ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মাঝে সুন্দর অবস্থা বিরাজ করছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ও বিজয় একাত্তর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুল বাছির বলেন, অনেক সময় কিছু ছাত্রের সিটটা অনেক দরকার হয়। ঢাকায় কেউ নেই কিংবা থাকার মতো ব্যবস্থা নেই, তখন সে একটা উপায় খোঁজার চেষ্টা করে। আর সে সুযোগে কারো মাধ্যমে সে হলে ওঠে। এভাবেই গণরুমের সৃষ্টি হয়। বিশেষ কারণে কেউ হলে উঠতে চাইলে কিংবা কারও মাধ্যমে হলে উঠলে সেটা অনুমতি সাপেক্ষে হওয়া উচিত। তাহলে শৃঙ্খলা থাকবে। তবে হলগুলোতে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ আছে বলে দাবি তার।

প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সহাবস্থান, শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখা, সকল শিক্ষার্থীর সম্মান আমাদের কাছে সমান। এটি বজায় রাখতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি, করে যাব। সবার কাছে সহযোগিতা চাচ্ছি এবং সবার ভালো পরামর্শও কাম্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সহাবস্থান আছে, সকল শিক্ষার্থী মিলেমিশে বসবাস করছে। কখনও কখনও দুয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায়। সেগুলো যাতে না ঘটে ওই নিরিখে আমাদের উদ্যোগ আছে। আমরা সকল পক্ষ থেকেই দায়িত্বশীল আচরণ আশা করি, যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।

তিনি বলেন, বিভিন্ন জনের বিভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে, কারও উদ্দেশ্য থাকে ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করা। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্যাম্পাস ও শিক্ষার পরিবেশ সুন্দর রাখা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের থেকে দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশিত। কেউ শৃঙ্খলা পরিপন্থী, অছাত্রসুলভ আচরণ করবে এটা গ্রহণযোগ্য নয়। 

সহাবস্থান নিশ্চিতের দাবি বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের

উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসা ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলায় জড়িত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল৷ এক বিবৃতিতে তারা বলেছেন, ছাত্রদলের নিরাপদে সাক্ষাতের বিষয়টি নিশ্চিত করা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, বিশেষ করে প্রক্টরিয়াল বডি তা করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে৷ তাদের এ ব্যর্থতার কারণে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা ছাত্রলীগের দুষ্কৃতকারীদের হামলার শিকার হয়ে রক্তাক্ত ও আহত হয়েছেন।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধি এবং স্বাধীন চিন্তাচর্চা ও লালনের প্রধান কেন্দ্র। এখানে ক্রীয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলো নির্বিঘ্নে তাদের কর্মসূচি পালন করবে এটিই প্রত্যাশিত। কিন্তু আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্যাম্পাসকে সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনের একক আধিপত্যের লালনভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সহাবস্থানের ঐতিহ্যকে ভুলুণ্ঠিত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্বিকার ভূমিকার সুযোগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু এ অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়। দ্রুত এর অবসান হওয়া প্রয়োজন।


এইচআর/এনএফ