বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদ, লেখক, গবেষক, ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৮৭তম জন্মদিন উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (২৩ জুন) বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে একক আত্মজৈবনিক বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। 

স্মৃতি বক্তৃতায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমার বাবা ছিলেন আমলাতান্ত্রিক, মা ছিলেন গণতান্ত্রিক। বাবা ছিলেন আশাবাদী, মা তার বিপরীত। অর্থাৎ জীবনের সব ক্ষেত্রে খুব বাস্তববাদী। ফলে আমি যতটা না বাবার সন্তান তার চেয়ে অধিক মায়ের সন্তান আমি। মায়ের অনেক গুণ পেয়েছি, আর তা বুঝলাম ধীরে ধীরে চলতে চলতে।

শৈশব-কৈশোরের নানা গল্প, শিক্ষাজীবনে মা-বাবার ভূমিকা, দেশ-বিদেশে উচ্চশিক্ষার অভিজ্ঞতা, শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভয়াবহ সময়ের অনেক স্মৃতি উপস্থিত অগণিত দর্শকের সামনে সাবলীলভাবে বলে যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

তিনি বলেন, ব্রিটিশ উপনিবেশ, পাকিস্তানি শাসন ও বাংলাদেশ তিন যুগ পার করছি আমরা। রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আমলাতান্ত্রিকতার ধাঁধা থেকে আমরা এখনো বের হতে পারিনি। রাষ্ট্রের বদল হয়েছে, ঔপনিবেশিকতার বদল হয়নি। জাতি সমস্যার সমাধান হয়েছে, কিন্তু শ্রেণি সমস্যার সমাধান হয়নি। এখনো শ্রেণিসংগ্রাম চলছে।

তিনি আরও বলেন, হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে তোলা সভ্যতা এখন ক্রান্তিলগ্নে উপস্থিত। এ থেকে উত্তরণের জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। সামাজিক মালিকানাও ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের সংস্কৃতিতে বিদ্রোহ আছে, বিষণ্ণতা আছে। হতাশা করোনার চেয়েও বেশি সংক্রমণ করে। এসব থেকে মুক্তির জন্য সামাজিক বিপ্লব ছাড়া কোনো পথ নেই।

নিজের কর্মজীবন সম্পর্কে এ শিক্ষাবিদ বলেন, আমার কাজকে আমি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে দেখি। বিভিন্ন আন্দোলনে যুক্ত হয়েছি। কোনো রাজনৈতিক স্বার্থে নয়, অধিকার আদায়ের স্বার্থে। ছাত্র জীবন ও কর্মজীবনে বহুবার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও অধিকার আদায়ের স্বার্থে।

নিজের জীবনের শেষ ইচ্ছে সম্পর্কে বলেন, একটা সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী সংগঠন করতে চাই। পাঠাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারা দেশব্যাপী আমাদের কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দিতে চাই, যেখানে কিশোররা সম্পৃক্ত হবে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক প্রতিযোগিতা হবে। তরুণরা জনহিতকর কাজ করবে। একটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিপ্লব সংঘটিত হবে।

এ সময় তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি নূরুল হুদা, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ড. আনু মুহাম্মদ, কবি মোহাম্মদ সাদেক, আন্দালিব রাশদী, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, মাজহারুল ইসলাম বাবলাসহ আরও অনেকে। এ ছাড়াও রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়।

অনুষ্ঠানে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নির্বাচিত সাক্ষাৎকার ‘আজ ও আগামীকাল’ বইয়ের মোড়কও উন্মোচিত হয়েছে। মোড়ক উন্মোচন করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক  আজফার হোসেন ও বইটির সম্পাদক ইমরান মাহফুজ। বইটি প্রকাশ করেছে ডেইলি স্টার বুকস, সম্পাদনা করেছেন ইমরান মাহফুজ। ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত ২১টি সাক্ষাৎকার এতে স্থান পেয়েছে। প্রচ্ছদ করেছেন মনন মোরশেদ।

বইয়ে উঠে এসেছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাম্যবাদী রাজনৈতিক দর্শনে অবিচল চিন্তা, সমাজ বিপ্লবে তরুণদের ভূমিকা। একইসঙ্গে বিভিন্ন সময়ের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে গভীর দার্শনিকতা ও ইতিহাস চেতনা, সামাজিক সংকট ও সামাজিক মুক্তিতে সংস্কৃতি চর্চার প্রয়োজনীয়তা।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন বিক্রমপুরের বাড়ৈখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার কর্মসূত্রে তার শিক্ষাজীবনের প্রথমভাগ কেটেছে রাজশাহীতে। পরে ঢাকা, কলকাতা ও যুক্তরাজ্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন তিনি।

এইচআর/আরএইচ