তীব্র ঝুঁকিতে ৪শ শিক্ষার্থী
এসএম হলে ‘মৃত্যুর’ সঙ্গে বসবাস তাদের
* দিনদিন তীব্র হচ্ছে ঝুঁকি
* দুইবার দেওয়া হয়েছে নোটিশ
বিজ্ঞাপন
* বিকল্প আবাসন নিয়ে উদাস হল ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ
* দুর্ঘটনার অপেক্ষা করছে প্রশাসন!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের বারান্দাসহ কয়েকটি ভবনের বিভিন্ন কক্ষে ছাদের পলেস্তারা দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে খসে পড়ছে। পলেস্তারা খসে পড়ে বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহতও হয়েছেন। যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা আছে সেখানে। এরপরও এখনো সেখানে থাকছেন শিক্ষার্থীরা।
২ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী আবুল কালাম শিকদার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এসব কক্ষ জরুরি ভিত্তিতে খালি করার জন্য হল প্রশাসনকে অনুরোধ জানানো হয়। এতে বলা হয়, ছাত্রদের নিরাপত্তার স্বার্থে বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী চিহ্নিত নিচতলা ও দোতলার বারান্দার ফাটল সংলগ্ন ৩৬টি কক্ষ জরুরি ভিত্তিতে খালি করা প্রয়োজন। বিষয়টি অতীব জরুরি।
এসএম হল সূত্রে জানা যায়, ৮, ৯, ১০, ১১ ও ১২ নম্বর কক্ষসহ হলের ৩৬টি কক্ষকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব কক্ষে ২ শতাধিক ছাত্র থাকেন। এছাড়া ফাটল দেখা দেওয়া পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশের বারান্দায়ও অবস্থান করছেন ২শর মতো শিক্ষার্থী।
গত ৯ মে হল প্রভোস্ট অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব কক্ষ ও বারান্দায় অবস্থান করা ছাত্রদের কক্ষ খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ঐ বিবৃতিতে বলা হয়, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের নিম্নোক্ত কক্ষ সমূহ এবং দক্ষিণ পশ্চিম পাশের বারান্দা সমূহে ফাটল থাকার কারণে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। শীঘ্রই সংস্কার কাজ শুরু হবে বিধায় অতি সত্বর বারান্দা ও কক্ষসমূহ খালি করার জন্য নির্দেশ দেয়া হলো।
১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর জগন্নাথ হলের একটি আবাসিক ভবনের ছাদ ধসে পড়ে মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারান ৩৯ জন ছাত্র, কর্মচারী ও অতিথি।
গত ২ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী আবুল কালাম শিকদার স্বাক্ষরিত আরেক বিজ্ঞপ্তিতে এসব কক্ষ জরুরি ভিত্তিতে খালি করার জন্য হল প্রশাসনকে অনুরোধ জানানো হয়। এতে বলা হয়, ছাত্রদের নিরাপত্তার স্বার্থে বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী চিহ্নিত নিচতলা ও দোতলার বারান্দায় (১২ মিঃ মিঃ ঊর্ধ্বে ফাটল) Steel Props স্থাপন করার লক্ষ্যে বারান্দার ফাটল সংলগ্ন ৩৬টি কক্ষ জরুরি ভিত্তিতে খালি করা প্রয়োজন। বিষয়টি অতীব জরুরি।
বারান্দায় ফাটল দেখা দেওয়ায় ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে এই হলে কোনো ছাত্রকে অ্যালটমেন্ট (বরাদ্দ) দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেই সময় হলের বারান্দায় থাকা সব শিক্ষার্থীকে রুম বরাদ্দ দিয়ে বারান্দা খালি করা হবে বলে জানিয়েছিলেন ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।
সে ঘোষণার প্রায় ১ বছর হলেও সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফাটল ধরা বারান্দায় ঝুঁকি নিয়ে এখনো থাকছেন শিক্ষার্থীরা। সারি সারি চৌকিতে মশারি টাঙিয়ে খোলা বারান্দায় থাকেছেন ২য় ও ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থীরা।
চিহ্নিত করা ৩৬টি কক্ষ ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি কক্ষে ফাটল ও পলেস্তারা খসে পড়তে দেখা গেছে।
উপায় নেই শিক্ষার্থীদের
শিক্ষার্থীরা বলছেন, তারা বাধ্য হয়েই ঝুঁকিপূর্ণ এসব কক্ষে থাকছেন। হল প্রশাসন কক্ষ খালি করতে বললেও অন্য কোনো ব্যবস্থা তাদের জন্য রাখা হয়নি। যখনই হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করা হবে, তখনই তারা কক্ষ ছাড়বেন।
অন্যদিকে হল প্রশাসন বলছে, তারা চেষ্টা করছেন শিক্ষার্থীদের দ্রুত সরিয়ে নিতে। ছাত্রনেতাসহ সবার সহযোগিতা পেলে অছাত্রদের বের করে সেখানে নিয়মিত ছাত্রদের বরাদ্দ দেওয়া হবে। এছাড়া কিছু শিক্ষার্থীকে বঙ্গবন্ধু হলের নতুন ভবনে ট্রান্সফার করারও চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।
কিফায়াত উল্লাহ নামের এক আবাসিক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, রুমের অবস্থা বেশি ভালো নয়। উপর থেকে পলেস্তারা পড়ে। কিন্তু আমাদের থাকার জায়গা নিশ্চিত না করলে রুম খালি করব কীভাবে? প্রশাসন থাকার ব্যবস্থা করে দিলে রুম খালি করে দিতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
মাসুম বিল্লাহ নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের রুমের প্রায় অর্ধেকের বেশি অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। পলেস্তরাও খসে পড়ছে। কয়েকদিন আগে মেরামত করলেও সেটা ভালোভাবে করা হয়নি, উল্টো আস্তরণ খসে পড়ছে। ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আমরা বাধ্য হয়ে থাকছি। কিছু করার নেই।
কী বলছে কর্তৃপক্ষ?
এ বিষয়ে হল প্রভোস্ট অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের হলটি বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখছি। আমরা একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছিলাম। সেই কমিটির প্রতিবেদনেও হলটি অত্যন্ত ঝুঁকিতে আছে বলা হয়। ইতোমধ্যে আমরা বারান্দা এবং ৩৬টি কক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছি। শিক্ষার্থীদের দ্রুত সময়ের মধ্যে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।
কীভাবে সরিয়ে নেওয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ভেবেছিলাম শিক্ষার্থীদের জন্য টিন শেড করব কিন্তু সেটার অনুমতি পাইনি। হলে যেসব শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব নেই তাদের জায়গায় নিয়মিত শিক্ষার্থীদের তুলব। এছাড়া বাকি শিক্ষার্থীদের বঙ্গবন্ধু হলের নতুন ভবন প্রস্তুত হলে সেখানে ট্রান্সফার করা হবে।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষার্থীদের সচেতনতার জায়গাটা আরো শানিত করতে হবে। এখানে আর নতুন করে অ্যালটমেন্ট দেওয়া হবে না। এ অবস্থায় এটি ব্যবহার করা যাবে না। এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, এখানে ছাত্ররা বসবাস না করাই উত্তম। ঠাসাঠাসি করে তো নয়ই বরং বেশি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে যাতে শিক্ষার্থীরা অবস্থান না করে সে বিষয়ে আমরা উৎসাহিত করব।
এই হল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, এটা হল হিসেবে থাকবে না। এটা ভেঙে নতুন করে করা হবে। বড় করে হল বানানো হবে নতুবা জাদুঘর বানানো হবে। আমাদের ছাত্রদের জন্য হল লাগবে, এটাকে ভেঙে নতুন করে হল বানাতে হবে।
দুর্ঘটনার অপেক্ষায় প্রশাসন?
শিক্ষার্থীদের এখনো নিরাপদ জায়গায় না সরানোর ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, যেখানে ছাত্রদের থাকা উচিত হোটেলের মতো ভালো ও উন্নত পরিবেশে সেখানে তাদের রাখা হয়েছে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এমন জায়গায়। ছাত্ররা কীভাবে থাকছে, পড়াশোনার পরিবেশ আছে কি না- আমরা কি আদৌ এসব কেয়ার করি? হাজার হাজার ছাত্র গণরুমে থাকে, একটা পড়ার টেবিল নেই, এটা কেমন বিশ্ববিদ্যালয়!
তিনি বলেন, আমরা হয়ত একটা দুর্ঘটনার অপেক্ষায় আছি, যেমনটি ঘটেছিল জগন্নাথ হলে। তারপর হয়ত সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের টনক নড়বে। তারপর এটা নিয়ে লেখালেখি হবে, তারপর হয়ত একটি নতুন হল হবে। অঘটন না ঘটলে এদেশে কিছু হয় না।
ছাত্রদেরও দায় রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এত সমস্যা থাকার পরও ছাত্ররা/ছাত্রনেতারা কথা বলে না। সবাই চুপ করে বসে থাকে। বুক ফুলিয়ে কেউ বলে না আমার থাকার জায়গা নেই কেন? ছাত্র রাজনীতি তাহলে কীসের জন্য?
উল্লেখ্য, ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর জগন্নাথ হলের একটি আবাসিক ভবনের ছাদ ধসে পড়ে মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারান ৩৯ জন ছাত্র, কর্মচারী ও অতিথি।
এইচআর/জেএস/আরএইচ