১৬২ বছর ধরে জ্ঞান প্রদীপের ভূমিকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা উপমহাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারক প্রাচীন ব্রাহ্ম পাঠশালাটিই বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। বিশ্ববিদ্যালয়টির বয়স মাত্র ১৫ বছর হলেও প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর রয়েছে ১৬২ বছরের শিক্ষা, অবকাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম পাঠশালাটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয় ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫’ অনুমোদনের মাধ্যমে।
ব্রাহ্ম পাঠশালা থেকে জগন্নাথ কলেজ
বিজ্ঞাপন
মানিকগঞ্জ জেলার তৎকালীন বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ১৮৬৮ সালে তার পিতার নামে ব্রাহ্ম স্কুলের নামকরণ করেন জগন্নাথ স্কুল। পরে ১৮৮৪ সালে স্কুলটি জগন্নাথ কলেজে (দ্বিতীয় শ্রেণির) রূপ দেওয়া হয়। ১৯০৮ সালে এটি প্রথম শ্রেণির কলেজে উন্নীত হয়। প্রতিষ্ঠার সময় জগন্নাথ কলেজের ছাত্রসংখ্যা ছিল মাত্র ৪৮ জন।
১৯০৭ সালের ১ মার্চ একটি দলিলের মাধ্যমে ট্রাস্টি বোর্ডকে কলেজ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিশোরীলাল রায় চৌধুরী, রায়চন্দ্র কুমার দত্ত বাহাদুর ও আনন্দচন্দ্র রায় ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন। জগন্নাথ কলেজ অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নম্বর ১৯২০ এর ১৬) পাস হওয়ার পর ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে গঠন করা হয় গভর্নিং বডি। এর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালের ২০ আগস্ট। জগন্নাথ কলেজের প্রথম গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন টি. এমারসন। অধ্যক্ষ হিসেবে প্রথম দায়িত্ব পালন করেন শ্রীকুঞ্জ লাল নাগ (১৮৮৪-১৮৯৫)।
পুরান ঢাকায় নারী শিক্ষার অগ্রগতির জন্য ১৯৪২ সালে জগন্নাথ কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়। জগন্নাথ কলেজের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয় ১৯৩৫ সালের ২০ মার্চ। সন্তোষের মহারাজা মন্মথ রায় চৌধুরী এতে সভাপতিত্ব করেন। সেসময় বিএসসি (ব্যাচেলর অব সায়েন্স), বিকম (ব্যাচেলর অব কমার্স), বিএ (ব্যাচেলর অব আর্টস) ডিগ্রি কোর্সসহ সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হতো। কলেজটি সম্পূর্ণভাবে সরকারি কলেজে রূপান্তরিত হয় ১৯৬৮ সালের ১ আগস্ট।
দেশের সপ্তম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা
২০০১-০২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরাই প্রথম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সনদ লাভ করেন। ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু করে। চারটি অনুষদ, ২২টি বিভাগে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু হয়। এর প্রথম উপাচার্য ছিলেন- অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম খান। বর্তমানে ১১ একর জমির ওপর মোট ১১টি ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রয়েছে একটি শহীদ মিনার এবং ‘একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’ নামে একটি স্মারক ভাস্কর্য। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদ, ৩৬টি বিভাগ ও দুটি ইনস্টিটিউট (আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট এবং শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট) রয়েছে। ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব’ নামে একটি আবাসিক ছাত্রী হল, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য নিজস্ব পরিবহন সুবিধা, চিকিৎসার জন্য একটি মেডিকেল সেন্টার রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ অবস্থিত ধুপখোলায়। প্রতিবছর ২০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালন করা হয়।
আন্দোলন-সংগ্রামে জগন্নাথ
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সংশোধনী প্রস্তাব বাতিল করা হলে ২৬ ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম মিছিলে অংশগ্রহণ করেন তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ সব জাতীয় সংগ্রামে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ভাষা আন্দোলনে সর্বপ্রথম শহীদ হন জগন্নাথ কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রফিক উদ্দিন আহমদ। তার স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি একাডেমিক ভবনের তার নামে নামকরণ করা হয়।
৫২’র ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রকাশিত প্রথম পুস্তিকা ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’র লেখক ছিলেন জগন্নাথ কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান।
জগন্নাথের উজ্জ্বল নক্ষত্র
বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) যেসব শিক্ষক ও শিক্ষার্থী দেশ গড়ার কাজে অবদান রেখেছেন তারা হলেন, ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ, কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান, ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়া সাঁতারু ব্রজেন দাস, বাঙালি কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র, চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, শিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শওকত আলী, বিক্রমপুরের ইতিহাস খ্যাত লেখক শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, গবেষক গোলাম মুরশিদ ও মির্জা হারুন-অর রশিদ, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, লেখক ও দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দীন আহমেদ রাজু, প্রখ্যাত আয়ুর্বেদ শাস্ত্র বিশারদ যোগেশচন্দ্র ঘোষ, শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ইতিহাসবিদ ড. মাহমুদুল হাসান, অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত, লেখক কাজী মোতাহার হোসেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ. আর. ইউসুফ, গায়ক ফকির আলমগীর, কিরণ চন্দ্র রায়, সাংবাদিক রাহাত খান, আ ন ম বজলুর রহমান, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, সঙ্গীতশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী, ড. শামসুজ্জামান খান, হায়াৎ মাহমুদ, অভিনেতা এ. টি. এম. শামসুজ্জামান প্রমুখ। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৬৫৭ জন শিক্ষক, ১৪ হাজার ২০৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে সাতটি শিক্ষাবর্ষে ২১৪ জন শিক্ষার্থী এমফিল ও ৮৭ জন পিএইচডি করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় জগন্নাথ কলেজের ভূমিকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে জগন্নাথ কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে কার্যক্রম বন্ধ করে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে রূপান্তর করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম একাডেমিক কার্যক্রম চালুর সময় জগন্নাথ কলেজের ডিগ্রি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয়। তখন কলেজের তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে শিক্ষার্থী ছিল ৩০৩ জন।
১৯৪৯ সালে পুনরায় স্নাতক শ্রেণিতে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করা হয়। তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের গ্রন্থাগারের ৫০ ভাগ বই-পুস্তক এবং জার্নাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া হয়। সহযোগিতার জন্য জগন্নাথ কলেজের সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ও ঢাকা হল (বর্তমানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল) নামকরণ করা হয়।
জগন্নাথে সংগঠন
নেতৃত্ব বিকাশ ও বিভিন্ন দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে রয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, ক্যারিয়ার ক্লাব, সায়েন্স ফিকশন সোসাইটি, রঙ্গভূমি (জবি রঙ্গ), মাইম সোসাইটি, ডিবেটিং সোসাইটি (জেএনইউডিএস), রোভার স্কাউটস, রেঞ্জার ইউনিট, আইটি সোসাইটি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী জবি, বিএনসিসি, আবৃত্তি সংসদ, ফিল্ম ক্লাব, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, বাঁধন ইত্যাদি। এসব সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সমৃদ্ধ ক্যারিয়ার গঠনে নিজেকে অনন্য করে তুলতে পারেন।
নতুন ক্যাম্পাস
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আবাসনসহ নানা ধরনের সমস্যা সমাধানে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের জন্য প্রকল্পে এক হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকার প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন দিয়েছে ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর।
তানজীদ/এফআর