হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল দেশের একটি অন্যতম নান্দনিক স্থাপনা হতে যাচ্ছে। বিশ্বের সুন্দরতম সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আদলে তৈরি হচ্ছে তৃতীয় টার্মিনাল। যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। বর্তমানে ব্যবহৃত প্রথম ও দ্বিতীয় টার্মিনালের প্রায় চারগুণ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অক্টোবরে উদ্বোধনের অপেক্ষায় তৃতীয় টার্মিনাল। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর বৃহৎ প্রকল্পগুলোর মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল অন্যতম।

প্রায় ১৫ মিলিয়ন প্রবাসী বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে যাতায়াত করেন। বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৮০ লাখ যাত্রী প্রথম ও দ্বিতীয় টার্মিনাল ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক গন্তব্যে যান। তৃতীয় টার্মিনালের কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গরূপে শুরু হলে বছরে প্রায় ২ কোটি যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন।

তৃতীয় টার্মিনালের যাত্রা শুরু হলে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, সেবার আধুনিকতা উপভোগের সুযোগ তৈরি হবে। সেবার আধুনিকতা বাংলাদেশি এয়ারলাইন্সগুলো কতটুকু উপভোগ করতে পারবে কিংবা আন্তর্জাতিক রুটের মার্কেট শেয়ারের কত অংশই বা থাকবে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে। তা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে।

আন্তর্জাতিক রুটের মার্কেট শেয়ারের বড় অংশ বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে। মার্কেটের প্রায় ৭৫ শতাংশ রয়েছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে। আর বাংলাদেশ বিমান, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সসহ অন্যান্য দেশীয় বিমানসংস্থার কাছে অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ। বর্তমানে ৩৪টি বিদেশি এয়ারলাইন্স হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে যাত্রী বহন করছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপ-আমেরিকায় অবস্থান করছেন। যাত্রী পরিসংখ্যানে, আকাশ পরিবহনে বাংলাদেশ একটি বৃহৎ মার্কেট। এই মার্কেটকে নিজেদের করে নিতে বিশ্বের বিভিন্ন এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। 

প্রথমবারের মতো আফ্রিকার অন্যতম এয়ারলাইন্স ইজিপ্ট এয়ার সম্প্রতি ঢাকা থেকে কায়রোতে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেছে। ইজিপ্ট এয়ারের মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে আকাশপথে শক্তিশালী যোগাযোগ রয়েছে। আফ্রিকার আরেকটি এয়ারলাইন্স ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা করছে। ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। বাংলাদেশি যাত্রীরা নতুন নতুন এয়ারলাইন্সের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন।

বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্স বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়ার গারুদা ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়ান এয়ার, ইরান এয়ার, ইরাকি এয়ারওয়েজ বাংলাদেশে যাত্রী পরিবহনের জন্য পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। ভারতের পাঁচটি এয়ারলাইন্স বর্তমানে বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এছাড়া বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানা যাচ্ছে, আরও দু’টি ভারতীয় এয়ারলাইন্স বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করতে আগ্রহী।

নয় বছর আগে স্থগিত হওয়া পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (পিআইএ) পুনরায় ঢাকার সঙ্গে আকাশ পথে সংযোগ স্থাপন করতে চায়। এছাড়া ১৫ বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া বিশ্বের অন্যতম প্রধান এয়ারলাইন্স ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এখানে উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটা বড় অংশ বসবাস করেন।

মালয়েশিয়াভিত্তিক বাজেট এয়ারলাইন্স এয়ার এশিয়ার কার্যক্রম সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশি প্রবাসীরা অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, জাপানে বসবাস করেন। যেখানে এয়ার এশিয়ার আকাশ পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ শক্তিশালী। ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে এয়ার এশিয়ার নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। বর্তমানে ঢাকা থেকে প্রতিদিন তিনিটি করে ঢাকা-কুয়ালালামপুর-ঢাকা ও প্রতিদিন একটি করে ঢাকা-ব্যাংকক-ঢাকা রুটে এয়ার এশিয়া ফ্লাইট পরিচালনা করছে। আর প্রতিদিন ছয়টি ফ্লাইট কুয়ালালামপুর থেকে ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশি যাত্রীদের কুয়ালালামপুর হয়ে ইন্দোনেশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ সুবিধা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখা যায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) এমিরেটস, ফ্লাই দুবাই, ইতিহাদ ও এয়ার অ্যারাবিয়া বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোনো আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা করছে। যা এভিয়েশনের ‘ফিফথ ফ্রিডম রাইট’ নিয়ে বাংলাদেশের সিভিল এভিয়েশন অথরিটির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছে। নতুন করে ইউএইয়ের বাজেট এয়ারলাইন্স উইজ এয়ার বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে।

আগ্রহী নতুন এয়ারলাইন্সগুলো যদি ফিফথ ফ্রিডম রাইটের কারণে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধনের পর বাংলাদেশের মার্কেটে প্রবেশ করে, তাহলে বর্তমানে আন্তর্জাতিক রুটের মার্কেট শেয়ারের দেশীয় এয়ারলাইন্সের ২৫ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশের নিচে নেমে আসার শঙ্কা থাকবে। বর্তমানে জিডিপির প্রায় ৩ শতাংশ আসে এভিয়েশন অ্যান্ড ট্যুরিজম খাত থেকে। আন্তর্জাতিক রুটের মার্কেট শেয়ার যদি কমে যায় তাহলে জিডিপিতেও এর প্রভাব পড়বে।

দেশীয় এয়ারলাইন্সের কাঠামোগত অবস্থান বিবেচনায় আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। সঠিকভাবে নির্ধারিত না হলে জাতীয় বিমান সংস্থাসহ সকল দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে। দেশের এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির প্রয়োজনে, পর্যটন খাতের উন্নয়নে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জিডিপিতে অংশীদারিত্ব বাড়ানোর জন্য এভিয়েশন ও পর্যটন খাতের উন্নয়নে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই জরুরী।

লেখক : মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স