৫ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটারের থার্ড টার্মিনালে একসঙ্গে ৩৭টি প্লেন রাখা যাবে/ ছবি : সংগৃহীত

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বর্তমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের সিংহভাগ কাজ করছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। তবে নির্মাণাধীন থার্ড টার্মিনালের (তৃতীয় টার্মিনাল) দায়িত্ব পাচ্ছে না তারা। বেবিচক জানিয়েছে, এই কাজে আগ্রহ দেখিয়েছে জাপান। তাদেরকেই এই কাজ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং বলতে- যাত্রীর বোর্ডিং পাস ইস্যু, ব্যাগেজ আনা-নেওয়া, কার্গোর মালামাল উঠানো-নামানো, এয়ারক্রাফটের সবধরনের সার্ভিসকে বুঝায়।

বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে টার্মিনাল পরিচালনা ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ জাপানকে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে বিষয়টি চূড়ান্ত হতে আরও অন্তত এক থেকে দেড় বছর সময় লাগতে পারে। তৃতীয় টার্মিনাল চালুর পর বেবিচক দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানকে সাময়িকভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব দেবে। তবে বিমানের এ কাজ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

১৯৭২ সাল থেকে দেশের সব বিমানবন্দরে এককভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ করে আসছে বিমান। নিজেদের ফ্লাইটের পাশাপাশি ৩২টির মতো ফ্লাইটের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের সেবা দিচ্ছে তারা। তবে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সসহ বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো নিজস্বভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং করে আসছে।

আরও পড়ুন : থার্ড টার্মিনালের কাজ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি এগিয়েছে

বেবিচক সূত্র জানায়, ২০২২ সালে দুর্বল লাগেজ হ্যান্ডেলিং সেবা নিয়ে বার বার অভিযোগ উঠছিল বিমানের বিরুদ্ধে। এছাড়াও লাগেজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, সময়মত কার্গোর মাল আনলোড-অফলোড না করায় অনেকেই বিমানের সেবা নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়েও অসন্তোষ ছিল। তাই বেবিচক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভবিষ্যতে বিমানের হাত থেকে অপর দুই টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব চলে যাওয়ারও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সরকার বিমানবন্দরের অপারেশনাল মেন্টেনেন্সসহ গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে জাপানকে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের গঠিত একটি কমিটি এ সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের কাজ দেওয়ার জন্য কী ধরনের টার্মস (শর্তাবলী) দেওয়া হবে সেটি নির্ধারণে পিপিপির মাধ্যমে ট্রানজেকশনাল অ্যাডভাইজার নিয়োগ করা হবে। টার্মসগুলোতে জাপান যদি রাজি হয় তাহলে তারা এই দায়িত্বগুলো পাবে।

জাপানকে দায়িত্ব দেওয়ার আগে প্রায় এক বছরের মতো অন্য প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ করবে।

এ সময়ের জন্য বিমান হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব পাবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, টার্মিনাল তৈরির কাজ এ বছরেই শেষ হবে। ২০২৪ সালে অপারেশনের কাজ শুরু হবে। জাপানের প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত সিভিল এভিয়েশন এই এয়ারপোর্টকে ফাংশনাল করার কাজ করবে। তবে ওই সময়টুকুতে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব কাকে দেওয়া হবে সেটার সিদ্ধান্ত সিভিল এভিয়েশন নেবে। বিমানকেই যে কাজ দেওয়া হবে এমনটা বলিনি, আমাদের কাছে অনেক অপশন আছে। বেবিচক টেম্পোরারি যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে এই দায়িত্ব দিতে পারে।

গণশুনানিতে বিমানের ব্যাগেজ হ্যান্ডেলিং নিয়ে অভিযোগ

যাত্রীসেবার মান নিশ্চিত করতে গণশুনানির আয়োজন করে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ ৩টি শুনানিতে বিমানের ব্যাগেজ হ্যান্ডেলিং (গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং) নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন যাত্রীরা। যাত্রীদের অভিযোগ, দক্ষ জনবল, পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে তারা সময়মত ব্যাগেজ পাচ্ছেন না, ব্যাগেজে কাটাছেঁড়া থাকছে, ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় ব্যাগেজ আসছে। এছাড়াও দেরিতে ব্যাগেজ আসা এবং চেক-ইন ব্যাগে দেরিতে প্লেনে পৌঁছানোর অভিযোগও রয়েছে।

এছাড়াও শুনানিতে একাধিক বিদেশি এয়ারলাইন্স অভিযোগ করেছে, বিমান তাদের কাছ থেকে চার্জ নিলেও সময়মতো গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দিচ্ছে না। ব্যাগেজ প্লেনে পৌঁছাতে দেরি হওয়ার কারণে এয়ারলাইন্সগুলো সময়মতো ফ্লাইট ছাড়তে পারছে না। পাশাপাশি ব্যাগেজ বেল্টে দেরিতে লাগেজ দেওয়ায় যাত্রীরা এয়ারলাইন্সের ওপর ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। এতে অনেক এয়ারলাইন্সের সুনাম নষ্ট হচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয়।

বিমানের রাজস্বে ধস নামতে পারে

বেবিচক সূত্র জানায়, জাপানি প্রতিষ্ঠান যদি তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ ঠিকভাবে করতে পারে সেক্ষেত্রে বিমানের হাতে থাকা প্রথম ও দ্বিতীয় টার্মিনালের সব গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজও পাবে তারা। সে ক্ষেত্রে বিমানের রাজস্ব আয়ে বড় ধস নামতে পারে।

আরও পড়ুন : থার্ড টার্মিনালে থাকছে যেসব সুবিধা

বিমান সূত্র জানায়, বিমানের বছরজুড়ে বড় দুটি আয়ের উৎস হচ্ছে হজ ফ্লাইট ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং। তারা প্রতিবছর প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় করে শুধুমাত্র গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের মাধ্যমেই। থার্ড টার্মিনালের দায়িত্ব পেলে এই আয় ৪ হাজার কোটিতে গিয়ে ঠেকত। থার্ড টার্মিনালের কাজ তো পাচ্ছেই না বরং অন্য দুই টার্মিনাল থেকেও যদি বিমানকে সরিয়ে দেওয়া হয় সে ক্ষেত্রে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারা।

এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এমডি ও সিইও মো. শফিউল আলম বলেন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ে বিমানের যান্ত্রিক ঘাটতি ছিল, দক্ষ জনবলের ঘাটতি ছিল। এখন এসব বিষয়ে মনোযোগ দিয়েছি। যখন থার্ড টার্মিনাল শুরু হবে আমরা আশা করি গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের জন্য বিমান শতভাগ প্রস্তুত থাকবে।

অক্টোবরে তৃতীয় টার্মিনালের সফট ওপেনিং

বেবিচকের সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, মে মাসের আগ পর্যন্ত থার্ড টার্মিনালের নির্মাণকাজ ৬০ শতাংশের একটু বেশি সম্পন্ন হয়েছে। ইতিমধ্যেই টার্মিনাল ভবন দৃশ্যমান।

বেবিচক চেয়ারম্যান মফিদুর রহমান বলেন, আমরা এ বছরের শেষের দিকে টার্মিনাল সফট ওপেনিং করব। তবে এটি অপারেশনাল হবে না। অপারেশনাল কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হতে ২০২৪ সাল লাগবে।

আরও পড়ুন : শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল খুলছে ২০২৩ সালের অক্টোবরে

২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। জাপানের মিতসুবিশি ও ফুজিতা এবং কোরিয়ার স্যামসাংয়ের অ্যাভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম (এডিসি) এ টার্মিনালের নির্মাণকাজ করছে। টার্মিনাল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার আর বাকি অর্থ দেবে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)।

১৯৭২ সাল থেকে দেশের সব বিমানবন্দরে এককভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ করে আসছে বিমান। নিজেদের ফ্লাইটের পাশাপাশি ৩২টির মতো ফ্লাইটের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের সেবা দিচ্ছে তারা। তবে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সসহ বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো নিজস্বভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং করে আসছে।

৫ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটারের এ টার্মিনালে একসঙ্গে ৩৭টি প্লেন রাখার অ্যাপ্রোন (প্লেন রাখার জায়গা) করা হয়েছে। তবে এ টার্মিনালের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন হবে মডার্ন টার্মিনাল বিল্ডিং। দুই লাখ ৩০ হাজার স্কয়ার মিটারের বিল্ডিংয়ের ভেতরে থাকবে পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য ও অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির ছোঁয়া।

এতে থাকবে ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজের ব্যবস্থা। বহির্গমনের জন্য মোট ১১৫টি চেক-ইন কাউন্টার (১৫টি সেলফ সার্ভিস চেক-ইন কাউন্টার) থাকবে। এছাড়া ১০টি ই-গেটসহ বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার থাকবে ৬৬টি। আগমনীর ক্ষেত্রে ৫টি ই-গেটসহ মোট ৫৯টি কাউন্টার থাকবে। টার্মিনালে থাকবে ১৬টি ব্যাগেজ বেল্ট স্থাপন করা হবে। অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগেজের জন্য থাকবে চারটি পৃথক বেল্ট। ১ হাজার ৪৪টি গাড়ি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন বহুতল কার পার্কিং তৈরি করা হচ্ছে।

এআর/ওএফ