অগ্রসরমান অর্থনীতির বাংলাদেশ, এগিয়ে যাওয়ার সূচকগুলো ক্রমশই দেশকে মধ্য আয়ের দিকে ধাবিত করছে। মহামারি করোনাও অর্থনীতির এগিয়ে যাওয়ার পথকে রুদ্ধ করতে পারেনি। কিন্তু অগ্রসর অর্থনীতির বাংলাদেশ কিন্তু এভিয়েশনের সূচকগুলোকে যথাযথভাবে এগিয়ে নিতে পারছে না।

বাংলাদেশ এভিয়েশন ইতিহাস অনেকটা অম্ল-মধুর। আকাশ পরিবহনে বন্ধ হওয়ার মিছিলটা এগিয়ে যাওয়ার মিছিল থেকে অনেক বেশি সুসংহত। ৮ থেকে ৯টি বেসরকারি এয়ারলাইন্স গত দুই যুগে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। বিগত দিনে প্রত্যেকটি এয়ারলাইন্স বন্ধ হওয়ার ক্ষণে নতুন করে আবির্ভূত হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে চিরতরে অতল গহ্বরে স্থান করে নিয়েছে। 

জাতীয় বিমান সংস্থার সঙ্গে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ও নভোএয়ার দেশের এভিয়েশন শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে। নতুন দু’টি এয়ারলাইন্স ফ্লাই ঢাকা ও এয়ার অ্যাস্ট্রা নতুন স্বপ্ন নিয়ে রেগুলেটরি অথরিটি থেকে গত বছর বাংলার আকাশ পথে বিচরণ করার জন্য এনওসি নিয়েছে। 

স্বপ্ন দেখতে হয় জেগে জেগে, তাহলে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়। আর ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলে ঘুম ভাঙার পর স্বপ্নটা রণভঙ্গের মতো হয়ে যায়। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, শুরুর আগেই শেষের গল্প লেখা হয়ে যাচ্ছে। ফ্লাই ঢাকা স্বপ্ন ভঙ্গের মতো যুদ্ধের মাঠ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়া শুরু করেছে। যা বন্ধ হওয়ার মিছিলে নতুন আরেকটি পালক যুক্ত হওয়ার মতো। বিভিন্ন সময় সিভিল এভিয়েশন অথরিটি থেকে এনওসি নিয়েও অপারেশনে আসতে পারেনি এমন এয়ারলাইন্সের সংখ্যাও কম নয়। যার মধ্যে রয়েছে সাউথ এশিয়া এয়ারওয়েজ, রূপসী বাংলা এয়ারলাইন্স, নেপচুন এয়ারলাইন্স, এপিক এয়ার।

এয়ার অ্যাস্ট্রা বাংলাদেশ এভিয়েশনের এগিয়ে যাওয়ার মিছিলের গতি সঞ্চারে ভূমিকা রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের আকাশ পরিবহনে স্বপ্নের জাল বুনে প্রায় আট বছর পর দেশীয় এভিয়েশনে আশার প্রদীপ জ্বালাতে আসছে এয়ার অ্যাস্ট্রা। 

নতুনের আবির্ভাব পুরাতনকে উদ্বুদ্ধ করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। অনেক স্বপ্নকে সাথে নিয়ে বিমান বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু চলার পথে ছন্দপতন হয়েছে বহুবার।

মাঝে মাঝে খেলায় খেলোয়াড়দের উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলতে শোনা যায়, জয়-পরাজয় বড় কিছু নয়, অংশগ্রহণই বড় ব্যাপার। জাতীয় বিমান সংস্থা শুরু থেকে বিশ্ব এভিয়েশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। কিন্তু কখনই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়নি বাংলাদেশ বিমানকে। এভিয়েশনে স্থিতিশীলতার কোনো সুযোগ নেই, এগিয়ে যেতে হবে, বিস্তৃতি ঘটাতে হবে। প্রতিযোগিতা হতে হবে নতুন রুটের ক্ষেত্রে, নতুন নতুন উড়োজাহাজের সংযোজনের মাধ্যমে। প্রতিযোগিতায় থাকতে হবে সেবার নতুনত্বের মাধ্যমে। সব সূচকে আমরা কি পারছি বাংলাদেশ এভিয়েশনে?

পূর্বসূরি হিসেবে বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো বরাবরই জাতীয় বিমান সংস্থার পথ অনুসরণ করতে চেয়েছে। দেশের পতাকাকে সমুন্নত রাখতে বিদেশি বিমান সংস্থাগুলোর সাথে কতটুকু পেরে উঠতে পেরেছে? ৮০ কিংবা ৯০ দশকের সমপর্যায়ের রুটও এখন পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটাতে পারেনি জাতীয় বিমান সংস্থা। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করলেও বিশ্বের ৫০টি দেশের সাথে এয়ার সার্ভিস এগ্রিমেন্ট করতে পারেনি বাংলাদেশ। 

১৬ কোটি ৫০ লাখের অধিক জনসংখ্যার দেশে প্রায় ১৩/১৪ মিলিয়ন নাগরিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের বা শিক্ষার বা চিকিৎসার কারণে কিংবা পর্যটনে কারণে আকাশপথ ব্যবহার করছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক রুটের মার্কেট শেয়ারের প্রায় ৭০ ভাগ বিদেশি এয়ারলাইন্সের দখলে, সেখানে দেশীয় এয়ারলাইন্সের কাছে মাত্র ৩০ ভাগ যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। আরও বেশ কিছু বিদেশি এয়ারলাইন্সের আগমনে অপেক্ষায় বাংলাদেশের এভিয়েশন। ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক রুটের মার্কেট শেয়ারের অবস্থা কি হবে? ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত রাখতে বর্তমানকে সুসংহত রাখা খুবই জরুরি।

২০১৪ সালের দু’টি এয়ারক্রাফট নিয়ে যাত্রা শুরু করা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের প্রসার ও এয়ার অ্যাস্ট্রার আগমনের সংবাদে বাংলাদেশ এভিয়েশন যেন কিছুটা পজিটিভ মেরুকরণের গতিপথ পাওয়ার আশা করছে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক রুটের মার্কেট শেয়ার বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকছে বাংলাদেশি এয়ারলাইন্সের। দেশীয় এয়ারলাইন্সের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পসহ হোটেল ইন্ডাস্ট্রিও ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে।
 
গত ২৫ বছরে জিএমজি, ইউনাইটেড, রিজেন্ট এয়ারওয়েজের মতো এয়ারলাইন্স বাংলার আকাশ ছেড়ে বিশ্বের আকাশ দাপিয়ে বেড়ানো এয়ারলাইন্সগুলো অপারেশন শুরুর ১০ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে ইতিহাসের পাতায় স্থান নিয়ে বাংলাদেশ এভিয়েশনকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এ খাতে বিনিয়োগে অনুৎসাহী করে তুলেছে। সেই পুরোনো চিত্র নতুন করে পুনরাবৃত্তি হোক তা এভিয়েশন সংশ্লিষ্ট কেউই প্রত্যাশা করে না।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভের পর মাত্র ১৮ দিনের মাথায় ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি জাতীয় বিমান সংস্থা গঠন ও ঠিক এক মাস পর ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম বাণিজ্যিক ফ্লাইট শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন গঠন করেন ১৯৭৩ সালে। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের জীবদ্দশায় দেওয়া দিক নির্দেশনার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলছে উন্নয়নের সোপানে।

বাংলাদেশের যাত্রীদের ওপর ভিত্তি করে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ব্যবসায়িক পরিকল্পনা সাজায় অথচ বাংলাদেশি এয়ারলাইন্সগুলো সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে না, তা সত্যিই ভাবনার বিষয়। বাংলাদেশিদের দেশাত্মবোধকে সম্মানের জায়গায় রেখে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোকে সেবা প্রদান করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশি যাত্রীরা বিদেশি এয়ারলাইন্সের তুলনায় দেশীয় এয়ারলাইন্সে ভ্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে। ফলে শুধু এয়ারলাইন্সের আয় বাড়বে না, দেশীয় জিডিপিতে অধিক অংশগ্রহণ দেখা যাবে। বেকারত্ব দূরীকরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। 

দেশের নাগরিক হিসেবে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সসহ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বাংলাদেশি প্রবাসী অধ্যুষিত সকল দেশে ফ্লাইট পরিচালনা করবে, একজন নাগরিক হিসেবে সব সময়ের প্রত্যাশা। নীতি নির্ধারকরা সবক্ষেত্রে জাতীয় বিমান সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি এয়ারলাইন্সের গুরুত্ব অনুধাবন করে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ করে দিলে বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

বর্তমান যুগে বিশ্বের সব দেশের মতো বাংলাদেশেও উদীয়মান তরুণ সমাজ পাখির মতো ডানায় ভর করে নীলাকাশে ভ্রমণের স্বপ্ন দেখে। আর সেই স্বপ্ন পূরণে বর্তমানে আকাশ পরিবহনের প্রতি আগ্রহের মাত্রা যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। আর সেই স্বপ্ন পূরণে সঠিক দিক নির্দেশনা আর বাস্তবধর্মী ভবিষ্যৎ বাণিজ্যিক পরিকল্পনা বাংলাদেশের আকাশ পরিবহনকে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দিতে সহায়তা করবে।  

সঠিক পরিকল্পনায় স্বপ্নকে সাথে নিয়ে সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে নীলাকাশে ভেসে ভেসে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানোর প্রত্যাশায়।

লেখক : মো. কামরুল ইসলাম
মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স