বিমানের সেপ্টেম্বরের ২২ শ’ টিকিট হাওয়া, উমরাহর ভাড়া দেড় লাখ!
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সৌদি আরবের জেদ্দা ও মদিনা রুটের ৭৫ হাজার টাকার টিকিট বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ৩৬ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। পবিত্র উমরাহ হজের যাত্রীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় অগ্রিম বুকিং দেখিয়ে এই দুই রুটের সেপ্টেম্বর মাসের সব টিকিট আটকে ফেলেছে দেশের কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি। আর তাদের জন্য সেই পথ করে দিয়েছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা গেছে, আগামী মাসে (সেপ্টেম্বর) সৌদি আরবের উমরাহগামী যাত্রীদের বেশ চাপ রয়েছে। উমরাহ যাত্রীরা মূলত জেদ্দা ও মদিনা রুট ব্যবহার করে সৌদি আরবে প্রবেশ করেন। এই সুযোগে বিমানের কর্মকর্তারা কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সিকে এই দুই রুটের ইকোনমি ক্লাসের প্রায় ২২ শ’ টিকিট ‘গ্রুপ বুকিং’ করার সুযোগ দিয়েছে। ফলে সেপ্টেম্বরে টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। এতে ওই রুটে বিমানের ৭৫ হাজার টাকার ভাড়া গিয়ে ঠেকেছে প্রায় দেড় লাখে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, বর্তমানে বিমানের টিকিট কাটার জন্য নির্দিষ্ট যাত্রীর নাম ও পাসপোর্ট নম্বর প্রয়োজন হলেও বিমান কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ৪টি ট্রাভেল এজেন্সি কোনো যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর বা অন্য কোনো কাগজপত্র জমা না দিয়েই জেদ্দা ও মদিনা রুটের গ্রুপ টিকিট কেটে নিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
বুধবার (২৪ আগস্ট) বিমানের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে জেদ্দা ও মদিনা রুটের সেপ্টেম্বর মাসের ইকোনমি ক্লাসের কোনো টিকিট নেই। কেউ যদি সেপ্টেম্বরে বিমানের টিকিটে জেদ্দা রুটে যেতে চায় সেক্ষেত্রে তার ভাড়া পড়বে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ৯৯ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর মদিনা রুটের বর্তমান ভাড়া ১ লাখ ৩৬ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অথচ আগস্টে এ ভাড়া ছিল ৭২ থেকে ৭৫ হাজার টাকা। বর্তমানে বিভিন্ন এজেন্সি সর্বনিম্ন দেড় লাখ টাকায় ১৫ দিনের ওমরাহ প্যাকেজ ঘোষণা করলেও সেপ্টেম্বরে এই প্যাকেজ ২ লাখের বেশি পড়বে।
কারা কিনেছে, টাকার ভাগ কীভাবে হচ্ছে
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রথমে বিমানের বিপণন ও বিক্রয় শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা জেদ্দা এবং মদিনা রুটের ইকোনোমি ক্লাসের টিকিটগুলো ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা করে কিনে রেখেছেন। টিকিটগুলো ৪-৫টি ট্রাভেল এজেন্সির কাছে ৮৬ হাজার টাকায় বিক্রি করেন তারা। এভাবে এই বিভাগের কর্মকর্তা ও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রায় ২২০০ টিকিট বিক্রি করেছেন। ওই এজেন্সিগুলো সেই টিকিট বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর ও হজ এজেন্সির কাছে ৯৬ হাজার থেকে ১ লাখ ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছে।
বিমানের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে যে ৪ এজেন্সি জেদ্দা ও মদিনা রুটের টিকিট কেটে আটকে রেখেছে সেগুলো হলো- ইন্যামন এভিয়েশন লিমিটেড ( মতিঝিল), রয়েল এয়ার সার্ভিস সিস্টেম (নয়া পল্টন), কাজী এয়ার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড (নয়া পল্টন), স্টার হলিডেজ (পুরানা পল্টন)।
১ হাজারের বেশি টিকিট ‘গ্রুপ বুকিং’ দিয়ে কিনে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে কাজী এয়ার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেডের মালিক কাজী মোহাম্মদ মফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিমানের অনেক ফ্লাইটে যাত্রী হয় না। তাই বিমান আমাদের একসঙ্গে গ্রুপ টিকিট দিয়ে থাকে। আমরা সম্পূর্ণ নগদ টাকা দিয়ে গ্রুপ টিকিট কিনি। এটা নতুন কিছু নয়। গ্রুপ বুকিং করতে যাত্রীর পাসপোর্ট ও নাম লাগে না। আমরা নিয়ম মেনেই বিমান থেকে গ্রুপ বুকিং করেছি।'
উমরাহর টিকিটের দাম বাড়ার জন্য দায়ী বিমানের যেসব কর্মকর্তা
বিমানের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরের গ্রুপ টিকিট বিক্রির বিষয়টি মূলত বিমানের বিপণন ও বিক্রয় শাখার। এছাড়া মতিঝিল অফিসের দায়িত্বে থাকা বিমানের ডিস্ট্রিক্ট সেলস অফিসের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) আশরাফুল আলম এজেন্সির সঙ্গে গ্রুপ টিকিটের বিষয়ে আলোচনা করেন।
আশরাফুল আলম ২০১৯ সালে বিমানের মার্কেটিং ও সেলস বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ছিলেন। তবে টিকিট নিয়ে দুর্নীতির কারণে তাকে বিমান থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল।
সেসময় তাকে নিয়ে তৈরি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, আশরাফুল আলম অনলাইনে টিকিট বেচা বন্ধ করে দিয়েছেন এবং ম্যানুয়াল ব্যবস্থায় টিকিট বিক্রিতে ট্রাভেল এজেন্টদের সঙ্গে যোগসাজশ করছেন। এর ফলে বিমান ফাঁকা অবস্থাতেই উড়াল দিত, কিন্তু যাত্রীরা টিকিট পেত না। টিকিট বিক্রির অনিয়মের কারণে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিল বিমান।
তবে বিমানের সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সালেহ মোস্তফা কামাল সেসময় দায়িত্ব পাওয়া মাত্রই শাস্তিস্বরূপ শুধুমাত্র ‘ভৎসনা’ জানিয়ে ওই কর্মকর্তাকে দায়িত্বে পুনর্বহাল করেন। আবারও টিকিটিংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় তাকে।
এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় বিমানের বিপণন ও বিক্রয় বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) মোহাম্মদ মেহেদী হাসানকে তাৎক্ষণিক সেই বিভাগ থেকে বদলি করলেও আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিমান।
বিমানের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বুধবার গ্রুপ টিকিট বুকিং করার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে বিমান। এছাড়া পাসপোর্ট এবং যাত্রীর নাম ছাড়া বুকিং করারও সত্যতা পাওয়া গেছে। বিষয়টি জানার পর বিমান তৎক্ষণাৎ গ্রুপ টিকিট বিক্রি বন্ধের নির্দেশনা দেয়।
নাম-পাসপোর্ট ছাড়া বুকিংয়ের বিষয়ে জানতে বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে জিএম আশরাফুল আলমকে ফোন করা হলে তিনি ফোন কেটে দেন। ক্ষুদেবার্তা দেওয়া হলেও সাড়া দেননি তিনি।
এ বিষয়ে বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ও বিশিষ্ট এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক। রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্স হিসেবে বিমানের জনগণ ও ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যেই আচরণ করা উচিৎ ছিল, তারা তা করছে না। তাদের টিকিটিং প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ করতে হবে। বিমানে টিকিটিংয়ের নিয়মের ব্যতিক্রম কেন হচ্ছে আমরা তা বুঝতে পারছি না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে যাত্রীরা অন্য এয়ারলাইন্সের দিকে ঝুঁকে পড়বে।
এমডি বললেন, ‘আমি নিজে সব টিকিট বাতিল করব’
পাসপোর্ট নম্বর ও নাম ছাড়া কেন টিকিট বুকিং করা হলো জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও মো. যাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগামী মাসে এমনিতেই টিকিটের চাহিদা বেশি। কোনো টিকিট নাম ও পাসপোর্ট নম্বর ছাড়া কাটার কথা নয়, আমার নলেজে এমন কিছু নেই। যদি এমন হয় আমি নিজে সিস্টেমে বসে সব টিকিট বাতিল করব।
বিদেশি এয়ারলাইন্সের ভাড়া বিমানের চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ কম
বিমান বাংলাদেশ ছাড়াও ঢাকা থেকে উমরাহ যাত্রীদের বহন করে জেদ্দা ও মদিনা নিয়ে যায় এমিরেটস এয়ারলাইন্স, কাতার এয়ারওয়েজ ও সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্স (সাউদিয়া)। ঢাকা পোস্ট এসব এয়ারলাইন্সের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে ঢাকা থেকে জেদ্দা রুটে সাউদিয়ার রিটার্ন ভাড়া ১ লাখ ৩ হাজার টাকা, এমিরেটসের ভাড়া ৯০ হাজার ও কাতার এয়ারওয়েজের ভাড়া ৯১ হাজার টাকা। এছাড়া মদিনার রিটার্ন ভাড়া এমিরেটসে ৯২ হাজার, কাতার এয়ারওয়েজে ৯৩ হাজার এবং সাউদিয়াতে ১ লাখ ৬ হাজার ৭৯১ টাকা। প্রতিটি এয়ারলাইন্সের টিকিটের দাম বিমানের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম।
এআর/এসএম