১১১ সংখ্যাটি অনেক কিউট ও স্লিম, কিন্তু সব কিউট সুন্দর নয়!
প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের মূল্য ১১১ টাকা। এয়ারলাইন্স ব্যবসাকে থমকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কথিত আছে, ভাইস অ্যাডমিরাল নেলসন যুদ্ধে আহত হয়ে তার একটি পা, একটি হাত ও একটি চোখ হারান। তার সেই হতভাগ্য পরিণতির কথা স্মরণ করেই ১-১-১-এর এই বিশেষ নামকরণ। এরই ধারাবাহিকতায় ২২২ বা ৩৩৩-কেও কেউ কেউ আনলাকি’র কাতারে ফেলে থাকেন। এ কারণেই ১১১ ক্রিকেটে একটি অপয়া স্কোর!
দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের এভিয়েশনে ক্রিকেটের অপয়া সংখ্যাটিকে বরণ করতে হয়েছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কিছুদিন আগে দেখতে পেয়েছিলাম বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন আরেকটি অপয়া সংখ্যা ‘১৩’ যা সর্বজন স্বীকৃত, সেই সংখ্যাটিও বেছে নিয়েছিল। গত এপ্রিলে একসঙ্গে প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধি করে ১৩ টাকা, যা ছিল অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি।
বিজ্ঞাপন
আপনারা জেনে থাকবেন, বিভিন্ন এয়ারলাইন্স এয়ারক্রাফটে আসন সংখ্যার যে সিরিয়াল থাকে সেখানে ১৩ সিরিয়ালকে ইচ্ছাকৃত পরিহার করে থাকে। কথিত ১৩ সংখ্যাটি আনলাকি হিসেবে চিহ্নিত থাকায় বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন এয়ারলাইন্স ১৩ সিরিয়ালকে পরিহার করে থাকে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতভাবেই অপয়া সংখ্যাগুলোকেই বাংলাদেশ এভিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত করে দিচ্ছে, যা কাম্য হতে পারে না।
গত চার মাসে জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৩১ টাকা প্রতি লিটারে। আর কোভিডকালীন সময়সহ গত ১৯ মাসে জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে প্রতি লিটারে ৬৫ টাকা। যা এভিয়েশন ব্যবসাকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। এভিয়েশন খাতে বিনিয়োগ বাংলাদেশে সব সময়ই অতিমাত্রায় রিস্ক বহন করেছে। এ জন্যই গত ২৫/২৬ বছরে বেসরকারি বিমান পরিবহনের সময়কালে মাত্র ১০ থেকে ১১টি সংস্থা বাংলাদেশ এভিয়েশনে বিনিয়োগ করেছে। তার মধ্যে ৮ থেকে ৯টি সংস্থা ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। এর পেছনে অনেক কারণের মধ্যে জেট ফুয়েলের মূল্যবৃদ্ধি অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আছে।
কোভিডকালীন সময়ে পৃথিবীর সকল এয়ারলাইন্স চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রত্যেকটি দেশের সরকার কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এভিয়েশন ও ট্যুরিজমকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এয়ারলাইন্স ও ট্যুরিজম কোম্পানির পাশে দাঁড়িয়েছে। নানাধরনের প্রণোদনা, ভর্তুকি, চার্জ মওকুফসহ নানাবিধ কার্যক্রম দেখেছি। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে উল্টোচিত্র চোখে পড়েছে। করোনা মহামারির সময়ে এয়ারলাইন্সগুলোর পক্ষ থেকে মাত্রাতিরিক্ত অ্যারোনোটিক্যাল ও নন-অ্যারোনোটিক্যাল চার্জ কমানোর অনুরোধ উপেক্ষা করা হয়েছে। দফায় দফায় জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধি করে, এয়ারপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফি, সিকিউরিটি চার্জ যুক্ত করে এভিয়েশন খাতকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
ব্যাকলক চার্জগুলোর সারচার্জ বছরে ৭২ শতাংশ যা সহজেই অনুমেয়, এয়ারলাইন্সগুলোর ব্যবসাকে অনগ্রসর হতে সহায়তা করছে। যেসব এয়ারলাইন্স ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে, তাদেরও একটি অন্যতম দাবি ছিল সারচার্জ কমানোর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, দাবিগুলো চিরন্তন সত্যের মতো বাংলাদেশ এভিয়েশনে রয়ে যাচ্ছে। আর এয়ারলাইন্সগুলো ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছে না।
এই এভিয়েশনের সঙ্গে ট্যুরিজম ও হোটেল ইন্ডাস্ট্রির লাখ লাখ কর্মচারী-কর্মকর্তা জড়িত। জড়িত তাদের পরিবার। প্রো-অ্যাকটিভ হয়ে এসব বাস্তব সমস্যাগুলো সমাধানে কেউ নেতৃত্ব নেওয়ার দাবি এখন সময়ের প্রয়োজনে উল্লেখ করতে হচ্ছে।
দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ যারা কাজ, শিক্ষা, ভ্রমণ কিংবা চিকিৎসার প্রয়োজনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আকাশ পথে যাতায়াত করছেন। দেশের আন্তর্জাতিক রুটের শেয়ারের প্রায় ৭০ ভাগ চলে যাচ্ছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে। যদি জেট ফুয়েলসহ অন্যান্য চার্জ দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর অনুকূলে না থাকে তবে এভিয়েশন মার্কেটের পুরোটাই চলে যাবে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে। তখন আমাদের জিডিপির অংশীদারিত্ব কমে যাবে। যা দেশের আয়ের ওপর প্রভাব পড়বে। দেশের ট্যুরিজম চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বেকার সমস্যার সৃষ্টি হবে।
যেকোনো অপয়া সংখ্যা কিংবা অপয়া সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে এভিয়েশন সেক্টরকে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে সুস্থ প্রতিযোগিতা করার পরিবেশ তৈরি করে দিন। সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ পেলে এভিয়েশন সেক্টর বাংলাদেশে উন্নয়নের সোপানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স