কথায় আছে বীজ যত নিরাপদ ও উন্নত হবে ফসল ততো ভালো মানের হবে। তাই তো ফসলে ভালো ফলন পেতে হলে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে নিরাপদ বীজ উৎপাদনে। আর সবজি চাষে বীজের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।

নিরাপদ সবজির বীজ উৎপাদনের কৌশল ও প্রযুক্তি নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সবজি বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. বাহাউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে।

এ সবজি বিজ্ঞানী জানান, চারা উৎপাদন করে যে সব সবজি চাষ করা হয় তার মধ্যে বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপি, ব্রকলি, বেগুন, টমেটো, ক্যাপসিকাম, লাউ ও মিষ্টিকুমড়া অন্যতম। বর্তমানে আগাম শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন সময়ে সবজি চাষের জন্য চারা উৎপাদন বেশ প্রসার লাভ করেছে। উৎকৃষ্ট ও নিরাপদ সবজির চারা উৎপাদনের জন্য প্রচুর দক্ষতা এবং একাধিক বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।

শুরুতেই বীজতলার স্থান নির্ধারণে গুরুত্ব দিতে হবে। বীজতলার জমি অপেক্ষাকৃত উঁচু হওয়া উচিত যেন বৃষ্টির বা বন্যার পানি দ্রুত নিষ্কাশন করা যায়। ছায়াবিহীন, পরিষ্কার এবং বাতাস চলাচলের উপযোগী স্থানে বীজতলা করা প্রয়োজন। পানির উৎসের কাছাকাছি বাড়ি, খামার বা অফিসের কাছাকাছি হলে ভালো হয়।

বীজতলার মাটি বেলে দো-আঁশ বা দো-আঁশ এবং উর্বর হওয়া ভালো। বেলেমাটি বেশি হলে কাদামাটি, গোবর বা কম্পোস্ট মিশিয়ে অথবা অতিরিক্ত কাদামাটি হলে বালু, কম্পোস্ট বা গোবর মিশিয়ে মাটির জল ধারণ ও নিষ্কাশনের উপযোগী করে বীজতলার মাটি উন্নত করা যায়। বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদন করতে হলে বীজতলা যতদূর সম্ভব ক্রেতাদের কাছাকাছি এবং ভালো যোগাযোগ সম্পন্ন স্থানে স্থাপন করা উচিত।

বীজতলা তৈরি: একক বীজতলা বা হাপোর সাধারণত এক মিটার চওড়া ও তিন মিটার লম্বা হবে। জমির অবস্থাভেদে দৈর্ঘ্য বাড়ানো কমানো যেতে পারে। প্রয়োজনে বড় জমিকে ভাগ করে এভাবে একাধিক বীজতলা তৈরি করা যেতে পারে। পাশাপাশি দুটি বীজতলার মধ্যে কমপক্ষে ৬০ সেন্টিমিটার ফাঁকা রাখতে হবে।

বীজ বপনের কয়েক দিন আগে বীজতলার মাটি ২০-২৫ সেন্টিমিটার গভীর করে ঝরঝরা ও ঢেলা মুক্ত করে তৈরি করতে হবে। বীজতলা সাধারণত ১০-১৫ সেন্টিমিটার উঁচু করে তৈরি করতে হবে। মাটি, বালু ও পচা গোবর-সার বা কম্পোস্ট মিশিয়ে বীজতলার মাটি তৈরি করতে হয়।

মাটি উর্বর হলে রাসায়নিক সার না দেওয়াই ভালো। উর্বরতা কম হলে প্রতি ১০০ গ্রাম টিএসপি সার মেশাতে হবে বীজ বপনের এক সপ্তাহ আগে। যারা বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদন করেন তাদের জন্য ইট-সিমেন্ট দিয়ে স্থায়ী বীজতলা তৈরিই শ্রেয়।

বীজতলার মাটি শোধন: বীজ বপনের আগে বীজতলার মাটি বিভিন্ন পদ্ধতিতে শোধন করা যায়। এতে অনেক মাটিবাহিত রোগ, পোকামাকড় আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে দমন করা যায়। যেমন- সৌরতাপ ব্যবহার করে (কালো পলিথিন দিয়ে বীজতলা ঢেকে), জলীয় বাষ্প ব্যবহার করে, ধোঁয়া ব্যবহার করে, রাসায়নিক দ্রব্য যেমন ফরমালডিহাইড ব্যবহার করে, কাঠের গুঁড়া পুড়িয়ে, পোলট্রি রিফিউজ ব্যবহার করে।

এসব পদ্ধতির মধ্যে সবচাইতে সহজ ও কার্যকর পদ্ধতি হলো সৌরতাপ ব্যবহার করে বীজতলার মাটি শোধন করা। এক্ষেত্রে বীজ বপনের ১২-১৫ দিন পূর্বে বীজতলার  মাটি যথাযথভাবে তৈরি করে ভালোভাবে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। পরে পলিথিন দিয়ে বায়ু নিরোধক করে ঢেকে রাখতে হবে। এতে সারা দিনের সূর্যালোকে পলিথিনের ভেতরে বীজতলার মাটির তাপমাত্রা যথেষ্ট বৃদ্ধি পাবে ও অনেকাংশে মাটিবাহিত রোগজীবাণু দমন করবে। এছাড়াও অনেক ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও আগাছা দমন হয়।

বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সবজি চারা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে বীজতলায় রাসায়নিক দ্রব্য যেমন ফরমালডিহাইড পানিতে মিশিয়ে (৫০: ১) ব্যবহার করা হয়। পোলট্রি রিফিউজ ব্যবহার করেও বীজতলায় মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আংশিকভাবে বীজতলার মাটি শোধনের প্রক্রিয়া বর্তমানে দেশের অনেক সবজি উৎপাদন এলাকায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বীজ শোধন: বীজতলায় বপনের পূর্বে সবজি বীজ কয়েকটি পদ্ধতিতে শোধন করা যায়। এগুলোর মধ্যে গুঁড়ো রাসায়নিক ওষুধ দ্বারা বীজ শোধন পদ্ধতি বর্তমানে সর্বাধিক প্রচলিত ও কম ঝামেলা পূর্ণ। প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম প্রোভ্যাক্স-২০০ বা ক্যাপটান ব্যবহার করে বীজ শোধন করা যায়। বীজ শোধনের ফলে বিভিন্ন সবজির অ্যানথ্রাকনোজ, লিফস্পট, ব্রাইট ইত্যাদি রোগ ও বপন পরবর্তী সংক্রমণ রোধ সম্ভব হয়। বীজ শোধনকারী রাসায়নিক দ্রব্যাদি বিষাক্ত বিধায় শোধিত বীজ, শোধন সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

বীজ পরীক্ষাকরণ: শাকসবজির বীজ বপনের পূর্বে ভালোভাবে পরীক্ষা করে নেয়া প্রয়োজন। ভালো ও বিশুদ্ধ বীজের অভাবে, নির্দিষ্ট জাতের গুণাগুণ সম্পন্ন সবজির উচ্চফলন আশা করা যায় না। বীজের উৎকৃষ্টতা নির্ভর করে তার অঙ্কুরোদগম ক্ষমতার ওপর। 
অঙ্কুরোদগমের হার বের করার জন্য পেট্রিডিশ বা ছোট থালা নিয়ে তার ওপর ওই মাপের চোষ কাগজ পানি দিয়ে ভিজিয়ে ৫০-১০০টি বীজ সবজিভেদে কয়েক দিন রেখে অঙ্কুরোদগমের শতকরা হার বের করে নিতে হবে। বিভিন্ন সবজির অঙ্কুরোদগমের শতকরা সর্বনিম্ন গ্রহণযোগ্য হার বিভিন্ন সবজির জন্য বিভিন্ন রকম। তাহলে মূল্যবান বীজের সঠিক পরিমাণ, চারার সংখ্যা ইত্যাদি নির্ধারণ করা সহজ হবে।

বীজ বপন: বীজতলায় সারি করে বা ছিটিয়ে বীজ বপন করা যায়, তবে সারিতে বপন করা উত্তম। সারিতে বপনের জন্য প্রথমে নির্দিষ্ট দূরত্বে (৪ সেমি.) কাঠি বা টাইন দিয়ে ক্ষুদ্র নালা তৈরি করে তাতে বীজ ফেলে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। ছোট বীজের বেলায় বীজের দ্বিগুণ পরিমাণ শুকনো ও পরিষ্কার বালু বা মিহি মাটি বীজের সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে মাটিতে বীজ বপন করতে হয়। শুকনা মাটিতে বীজ বপন করে সেচ দেওয়া উচিত নয়, এতে মাটিতে চটা বেঁধে চারা গজাতে ও বাতাস চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে। তাই সেচ দেওয়া মাটির জো অবস্থা এলে বীজ বপন করতে হয়।

যে সমস্ত বীজের আবরণ শক্ত, সহজে পানি প্রবেশ করে না, সেগুলোকে সাধারণত বোনার আগে পরিষ্কার পানিতে ১৫-২০ ঘণ্টা অথবা শতকরা এক ভাগ পটাশিয়াম নাইট্রেট দ্রবণে এক রাত ভিজিয়ে বপন করতে হয় (যেমন লাউ, চিচিঙ্গা, মিষ্টি কুমড়া, করলা, উচ্ছে ও ঝিঙা)।

একে/এসএম