বিপদের দিন আর বেশি দূরে নেই। ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) ষষ্ঠ অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টে অন্তত তেমনই ইঙ্গিত। তাতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে অশনি সংকেত দেওয়া হয়েছে।

সাড়ে তিন হাজার পৃষ্ঠার বেশি এই রিপোর্টের উঠে এসেছে সুন্দরবন প্রসঙ্গও। ভারতীয় অংশের সুন্দরবনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতটা পড়তে পারে আইপিসিসির রিপোর্টের আলোকে তার একটা ধারণা দিয়েছেন দেশটির জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. অঞ্জল প্রকাশ। 

আমফানের প্রভাব

১৯৯৯ সালের পর আমফান ছিল বঙ্গোপসাগরের তৈরি হওয়া প্রথম সুপার সাইক্লোন। গত ১০০ বছরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ওপর আছড়ে পড়া সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণঝড়ের নাম আমফান। প্রবল শক্তিশালী হওয়ার পরও পশ্চিমবঙ্গের ওপর আমফান যতটা ক্ষয়ক্ষতি পারত, তার চেয়ে হয়েছিল কিছুটা কম। তার কারণ সুন্দরবন ঝড়ের গতি অনেকটা কমিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু তার মূল্য দিতে হয়েছে সুন্দরবনকে। প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হয়, প্রায় ১৬শ বর্গ কিলোমিটার ম্যানগ্রোভ অরণ্য ধ্বংস হয়েছিল আমফানের জন্য। একই সঙ্গে কলকাতার সবুজের বংশ ধ্বংস হয়ে যায় আমফানের প্রভাবে।

আনুমানিক ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল আমফানের জন্য। পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলা জুড়ে প্রায় ২৪ লাখ মানুষ ভিটেমাটি হারা হয়েছিল। পাশাপাশি প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝড়ের আগে ৮ লাখ মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমফানের মতো সুপার সাইক্লোন তৈরি হওয়ার পেছনে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি। তার সঙ্গে সেই সময় করোনা লকডাউন চলতে থাকায় অ্যারোসলের বৃদ্ধি ও সমুদ্রের উপর মেঘ জমতে থাকায় প্রধান কারণ।

বহুমুখী বিপদের আশঙ্কা

বহুমুখী বিপদ বলতে বিজ্ঞানীদের মতে, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, ভূমিধস ও আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে টোকিও, ওসাকা, করাচি, ম্যানিলা, তিয়ানজিন, জাকার্তা কলকাতা এ ছয়টি শহর বিপদের মুখোমুখি হতে চলেছে। এসব মেগাসিটিগুলোতে বর্তমানে সম্মিলিতভাবে ১৪৩ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করে। এসব নাগরিকরা ভবিষ্যতে ব্যাপক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে চলেছেন।

ব্যাপক খরা পরিস্থিতির সম্ভাবনা

শহরাঞ্চলে শুষ্ক মাটির পরিমাণ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। রিপোর্টে ২০০০ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে এশিয়ার বহু শহরে শুষ্ক মাটি ব্যাপক হারে বৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মেগাসিটিগুলোর মধ্যে রয়েছে, কলকাতা, দিল্লি ও করাচি। রিপোর্টে বলা হয়েছে ৩ লাখের বেশি বসবাস করে এরকম ৩৩০টি শহরে সব মিলিয়ে ৪১১ মিলিয়ন মানুষ এই সমস্যার মুখোমুখি হতে চলেছেন।

বন্যার কবলে পড়তে চলেছে বহু মহানগর

আইপিসিসির রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর বৃহত্তম ২০টি মহানগরে ব্যাপকভাবে বন্যার প্রভাব পড়তে পারে। এই ২০ শহরের মধ্যে ১৩টি এশিয়া মহাদেশে। এর মধ্যে নয়টি শহর এরকম রয়েছে যেগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে হয়তো বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। এই ৯ শহরের তালিকায় রয়েছে– কলকাতা, গুয়াংজু, তিয়ানজিন, হো চি মিন সিটি, জাকার্তা, ঝানজিয়াং, ব্যাংকক জিয়ামেন ও নাগোয়া।

সুন্দরনের উপর প্রভাব

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সুন্দরবনের নিচু অঞ্চল এবং ছোট ছোট দ্বীপতে লবণাক্ত সামুদ্রিক পানি প্রবেশ করবে বলে মনে করা হয়েছে আইপিসিসির রিপোর্টে। ফলে সুন্দরবনের বড় অংশের বাস্তুতন্ত্রের ব্যাপক পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর জেরে সুন্দরবন জুড়ে বর্তমান অর্থনীতি বা মানুষ যেসব উপায় নিজেদের জীবন-জীবিকা নির্বাহিত করে থাকেন সেগুলো ধীরে ধীরে অনুৎপাদনশীল হয়ে উঠবে। ফলে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন হতে পারে বলে রিপোর্টে মনে করা হয়েছে।

সুন্দরবনের ব-দ্বীপ অঞ্চলগুলোর পরিবেশগতভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল। খুব তাড়াতাড়ি সুন্দরবনকে সুরক্ষিত রাখার জন্য পরিকল্পনার প্রয়োজন।

ওএফ