খাটো জাতের নারিকেলের চারা কিনে ঠকছেন কৃষকরা!
আধুনিক কৃষি ও নতুন নতুন ফসল উৎপাদনে বিশেষ অবদান রাখায় সেলিম রেজার অর্জনের থলিতে রয়েছে একাধিক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। শত শত কৃষি উদ্যোক্তার আইকনেও পরিণত হয়েছেন তিনি। তবে হাতের স্পর্শে মাটিতে সোনা ফলানো এ কৃষি উদ্যোক্তা আজ অনেকটা অসহায়।
দীর্ঘদিন ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা বাগানের ২০ লাখ টাকার শতাধিক খাটো জাতের নারিকেল গাছ কেটে ফেলেছেন নাটোরের এ চাষি। তার দাবি, প্রতারণার শিকার হয়েছেন তিনি। নিম্নমানের চারা কিনে এবং কৃষি অফিসারের কথার প্রলোভনে পা দিয়ে নিজের সর্বনাশটা করেছেন।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে সেলিম রেজা বলেন, আমার এখানে আট বছরের পরিপূর্ণ শরিফার মাতৃবাগান ছিল। তৎকালীন কৃষি কর্মকর্তা এসএম শরিফুজ্জামান আমাকে ভিয়েতনামি খাটো জাতের নারিকেলের চারা রোপণের পরামর্শ দেন এবং কিছু ছবি দেখিয়ে আমাকে বলেন, প্রতি গাছে প্রায় আড়াইশর বেশি নারিকেল ধরবে।
তিনি বলেন, ২০১৫ সালের দিকে আমি কৃষি কর্মকর্তার কথায় বিশ্বাস রেখে শরিফার বাগানটি কেটে ভিয়েতনামের খাটো জাতের ২০০টি নারিকেলের চারা কিনে নিয়ে আসি। প্রতিটি চারার দাম নেওয়া হয়েছিল ৫০০ টাকা করে। ২০০টি চারার মধ্যে ১০৭টি চারা রোপণ করি। বাকিগুলো বিক্রি করে দিই। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রোপণ করার পর ছয় বছর কেটেছে। কোনো ইতিবাচক ফল পাইনি। উপরন্তু নারিকেলের গাছগুলো রোগ-বালাইয়ের আক্রমণে শেষ হয়ে গেছে।
দেশের বাইরে থেকে নিয়ে আসা নতুন প্রযুক্তি কোনো গবেষণা ও যাচাই-বাছাই না করে প্রলোভন দেখিয়ে কৃষকের হাতে তুলে দেওয়া কৃষি অফিসের উচিত নয় বলে মনে করেন সেলিম রেজা।
তিনি জানান, এ জাতের নারিকেল গাছ অতিরিক্ত রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হয় বলে প্রতিদিনই ওষুধ দিতে হয়। শীতকালে তো আরও বেশি ওষুধ দিতে হয়। শীতকাল সহ্যই করতে পারে না। এ নারিকেল গাছ চাষের জন্য বাংলাদেশের আবহাওয়া অনুকূল নয়। তাকে অন্তত ২০ জন কৃষক জানিয়েছেন যে, তারা ভালো ফল পাচ্ছেন না।
গাছগুলো কেটে ফেলার বিষয়ে এ কৃষক বলেন, এত টাকার সম্পদ তো কেউ নিজ ইচ্ছেতে নষ্ট করে না। গাছে মোচা আসে, কিন্তু ফল থাকে না। অনেক বিজ্ঞানী আমাকে বলেছেন, এতে ফল হবে না। কিন্তু আমি অনেক চেষ্টা করে দেখেছি। সবশেষে বাধ্য হয়ে ১০৭টি খাটো জাতের নারিকেল গাছ কেটে ফেলেছি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের একাধিক কৃষক এমন খাটো জাতের নারিকেল চারা কিনে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তবে এখনো কেউ নাম প্রকাশ করতে চান না। এ ছাড়া, কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নেওয়া খাটো জাতের নারিকেল চাষাবাদের কার্যক্রম নিয়ে অনেক কৃষি কর্মকর্তা ও গবেষকদের কাছ থেকেও নেতিবাচক মন্তব্য পাওয়া যায়।
২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে ‘দোয়ার হাইব্রিড নারিকেল’ (খাটো জাতের নারিকেল) চারা চাষিদের হাতে তুলে দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। মূল কাজটি সম্পাদন হচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অদিধফতরের হর্টিকালচারাল উইংয়ের অধীনে বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে ‘দোয়ার হাইব্রিড নারিকেল’ (খাটো জাতের নারিকেল) চারা চাষিদের হাতে তুলে দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। মূল কাজটি সম্পাদন হচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অদিধফতরের হর্টিকালচারাল উইংয়ের অধীনে বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে।
এ প্রকল্পের পরিচালক ও কৃষিবিদ মেহেদী মাসুদ দাবি করেন, কৃষি বিজ্ঞানী, চাষি থেকে শুরু করে সবার মনে প্রশ্ন ও কৌতুহল ছিল দেশের মাটিতে এটি সম্ভব কি না। কিন্তু আশার কথা হলো, অনেকেই ভালো ফল পাচ্ছেন। কেউ কেউ হয়তো আশানুরূপ ফল পাচ্ছেন না।
তিনি বলেন, এ জাতের নারিকেল গাছ চাষাবাদ অনেকটা ব্রয়লার মুরগির মতো। অনেক বেশি যত্ন নিতে হয়। যত্নে ঘাটতি থাকলে ভালো ফল পাওয়া যায় না। দক্ষিণাঞ্চলে কিন্তু খুবই ভালো ফল পাওয়া গেছে। নাটোরের ওই কৃষকের বাগানটি ছিল ড্রাগনসহ অন্যান্য ফলের মধ্যে। যার ফলে মাটিতে পুষ্টি উপাদানের হয়তো ঘাটতি হয়েছে। এতে হয়তো খুব বেশি ভালো ফল পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের (সম্প্রসারণ শাখা) অতিরিক্ত সচিব মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন ফসল চাষাবাদের বিষয়ে অবশ্যই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সবাই যে শতভাগ সফলতা পাবেন এমনটি নয়। তবে কোনো কৃষক যদি ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাহলে বিষয়টি আমরা দেখব। পাশাপাশি এমন কোনো ফসল আমরা আনতে চাই না, যে ফসলে কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়বেন।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের একাধিক বিজ্ঞানী নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, নারিকেলের এ জাতটি মাঠে নিয়ে যাওয়ার আগে আরও বেশি গবেষণার প্রয়োজন ছিল। নতুন ফসল সব মাটিতে ভালো হবে না, বিষয়টিও কৃষকের কাছে তুলে ধরা দরকার ছিল।
একে/আরএইচ