মুক্তা চাষে লাখপতি হওয়ার গল্প শোনালেন মামুন
ধরুন আপনার একটি ৭৫ শতাংশের পুকুর রয়েছে। সেখানে প্রতিবছরই মাছ চাষ করছেন। সেখান থেকে আয় হচ্ছে। সঙ্গে যোগ করলেন ঝিনুক চাষ। সেখানে ঝিনুক থেকে মুক্তা বিক্রি করলেন চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা।
বছর শেষে দেখা গেল মাছ চাষের চেয়ে কয়েকগুণ আয় এলো মুক্তা বিক্রি করেই। কি অবাক হলেন। অবাক করা হলেও ঘটনা সত্য। সঠিক ব্যবস্থাপনা আর যত্নে এমনই লাভজনক হয়ে উঠেছে মুক্তা চাষ। যার ফল দেশের তরুণেরা ঘরে তুলছেন।
হিসাবটা খুব পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলেন পাবনা জেলার সফল মুক্তা চাষি আল মামুন। তরুণ এ উদ্যোক্তা বলেন, ৭৫ শতাংশ পুকুরে মাছ চাষের পাশাপাশি কমপক্ষে ছয় হাজার ঝিনুক চাষ করা সম্ভব। তিনি নিজেও করছেন। প্রতিটি ঝিনুক সার্জারি পর্যন্ত ব্যয় হবে ২০ থেকে ২৫ টাকা। ২৫ টাকা করে ধরলে এতে মোট ব্যয় হয় এক লাখ ৫০ হাজার টাকা।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এ মুক্তা চাষি জানান, বাজারজাত উপযোগী মুক্তা তিন ক্যাটাগরিতে বিক্রি করা যায়। এ ক্যাটাগরির মুক্তা ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা সম্ভব। বি ক্যাটাগরির মুক্তা ১১৫ থেকে ১২৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। আর সি ক্যাটাগরির মুক্তা বাজারে ১০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। প্রতিটি ঝিনুক থেকেই যে মুক্তা পাওয়া যাবে এমন নয়। এর মধ্যে একটি অংশতে পাওয়া যাবে না।
এবার চূড়ান্ত ফলাফলটা বুঝিয়ে দিলেন মামুন। বলেন, মনে করুন আমি ছয় হাজার ঝিনুকের মধ্যে থেকে ২০ শতাংশতে কিছুই পাব না। তাহলে ছয় হাজার ঝিনুকের মধ্যে ১২০০ ঝিনুক বাদ দিলে থাকছে চার হাজার ৮০০টি। এখান থেকে সব তো এ ক্যাটাগরির হবে না। গড়ে ধরলাম ১১৫ টাকা করে প্রতিটি মুক্তা বিক্রি হবে। তাহলে চার হাজার আটশকে ১১৫ দিয়ে গুণ করলে মোট টাকা আসলো ৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা। খরচ হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তাহলে খরচ বাদ দিয়ে মুনাফা হচ্ছে চার লাখ দুই হাজার টাকা। আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ দুই হাজার টাকা বাদ দিয়ে দিলেও পকেটে চার লাখ টাকা সহজেই তুলতে পারছেন।
ডিপ্লোমা পাস করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মজীবন শুরু করা এ তরুণ বলেন, আমি নিজে সফলতা পেয়েছি। এটি ন্যূনতম আয়ের হিসাব ধরে বলেছি। আরও বেশি আয় হবে যদি আপনি সঠিক নিয়ম মেনে পরিশ্রম করতে পারেন। আগে বাজারজাত নিয়ে বেশ সমস্যা ছিল, এখন তা কেটে গেছে।
শুধু মামুন নয়, তার মতো একাধিক উদ্যোক্তার সঙ্গে ঢাকা পোস্টের কথা হয়। নিলফামারী জেলার হাবিবুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি প্রায় চার বছর ধরে মুক্তা চাষ করছি। শুরুতে বাজারজাত ব্যবস্থা ভালো না থাকায় তেমন আয় হয়নি। এখন একেকটি মুক্তা ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছি। দেশে মুক্তা দুই ভাবে চাষ হচ্ছে। একটি ইমেজ মুক্তা, আরেকটি গোল মুক্তা। বাজারে ইমেজ মুক্তার চাহিদা বেশি।
বাংলাদেশ মুক্তা চাষি উদ্যোক্তা সংগঠনের সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক লাভ হচ্ছে এ খবর শুনে মুক্তা চাষ করতে গেলে নিশ্চিত ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। এ বিষয়ে সঠিক প্রশিক্ষণ ও ধারণা নিয়ে মাঠে নামলে নিশ্চিত লাভ হবে। এটি অবশ্যই লাভজনক। তবে তা সঠিক পদ্ধতিতে করতে হবে। খুব যে আহামরি খরচ করতে হবে এমন নয়। শুরুতে প্রয়োজনে অল্প পরিমাণ দিয়ে শুরু করতে পারেন যে কেউ।
প্রাথমিক সাফল্য পাওয়ার পর ২০১৫ সাল থেকে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু হয়। এরপর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চাষিরা দক্ষতা অর্জন করে মাঠে নেমে যান। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সফলতা। প্রসারিত হতে থাকে মুক্তা চাষ। জুলাই ২০১২ থেকে জুন ২০১৯ মেয়াদে মুক্তা চাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে মূলত কাজ শুরু হয়।
দেশে যেভাবে মুক্তা চাষ শুরু
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) সূত্র জানায়, দেশে স্বাদু পানিতে প্রথমবার মুক্তা চাষ পদ্ধতি আবিষ্কারে সফলতা পান বিএফআরআইর মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহসেনা বেগমের নেতৃত্বে একদল গবেষক।
প্রাথমিক সাফল্য পাওয়ার পর ২০১৫ সাল থেকে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু হয়। এরপর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চাষিরা দক্ষতা অর্জন করে মাঠে নেমে যান। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সফলতা। প্রসারিত হতে থাকে মুক্তা চাষ। জুলাই ২০১২ থেকে জুন ২০১৯ মেয়াদে মুক্তা চাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে মূলত কাজ শুরু হয়।
বিএফআরআই মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহসেনা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় আমরা মুক্তা চাষ নিয়ে কাজ শুরু করি। ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের নিরলস পরিশ্রম আর সাধনায় মুক্তা চাষে এ সফলতা পাওয়া যায়। এখন অনেক চাষির ভাগ্য বদল হচ্ছে মুক্তা চাষে। এটি আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া।
মুক্তা চাষিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সততার সঙ্গে নিরলস পরিশ্রম করলে অবশ্যই মুক্তা চাষে সফলতা পাওয়া যাবে। কারও কাছ থেকে শুনে দ্রুত টাকা আয়ের জন্য মুক্তা চাষে নামলে ভালো ফল না পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু ভালোভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে সততার সঙ্গে মুক্তা চাষে নামলে সফলতা আসবে।
যেভাবে মুক্তা চাষে প্রশিক্ষণ পাবেন
যে কেউ মুক্তা চাষে আগ্রহী হলে তাকে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে গিয়ে আবেদন করতে হবে। প্রতিমাসে না হলেও অন্তত দুই মাস অন্তর এ বিষয়ে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে ড. মোহসেনা বেগম বলেন, ইনস্টিটিউটে থাকাসহ হাতে কলমে এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এখানে চাষিদের কোনো টাকা খরচ করতে হয় না। এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার জনকে এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আর বর্তমানে প্রায় ১০০ জনের বেশি চাষি মুক্তা চাষের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছেন।
একে/এসএসএইচ