সাগরের লোনা জলেও হবে ধান
সাগরের লোনা জলে ধান উৎপাদনের ধারণা হয়তো আপনার কাছে হেঁয়ালি মনে হতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশা বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য জোগানে উৎপাদনের একটি সম্ভাবনাময় উপায় হতে পারে সাগর কৃষি। বিশ্বের চারভাগের তিনভাগ জল আর একভাগ মাত্র স্থল। কিন্তু এই তিনভাগ জলের মাত্র একভাগ মানুষের ব্যবহারের উপযোগী।
বিশ্বব্যাপী এই একভাগের শতকরা ৭০ শতাংশ পানিই ব্যবহৃত হয় কৃষি উৎপাদনে। তাহলে বুঝতে অসুবিধা হয় না কৃষি উৎপাদন কতটা সেচ বা পানিনির্ভর। বর্তমানে ক্রমবর্ধমান খাদ্যের চাহিদা ও জনসংখ্যার বিস্ফোরণ বিজ্ঞানীদের এমন সব উৎপাদনের সম্ভাবনাময় দ্বার খুঁজে বের করতে বাধ্য করছে, যেখানে আগে কখনো কৃষি কাজ বা চাষাবাদ করার কথা চিন্তা করাই হয়নি।
একটি সাময়িকীতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, বিশ্বের বিপুল মানুষের খাদ্য চাহিদার জোগান দিতে যে একটি ফসলকে প্রাথমিকভাবে সাগরপৃষ্ঠে চাষাবাদের চিন্তা করছেন উন্নত বিশ্বের বিজ্ঞানীরা সেটি হচ্ছে ধান, যা বাংলাদেশসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের ফসল। মাত্র ২৪ বছর বয়সী দুই তরুণ বিজ্ঞানী ররি হর্নবি ও লুকি ইয়াং পরিচালিত অ্যাগ্রিসিয়া নামক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২০২১ সালের মধ্যে সাগরপৃষ্ঠে ভাসমান তলে লবণাক্ত সহনশীল ধান উৎপাদন করার উদ্যোগ নিয়েছেন। যারা ২০২০ সালে সাগরপৃষ্ঠে প্রথম পরীক্ষামূলক ধান আবাদের পরিকল্পনা হাতে নিয়ে কাজ শুরু করেন।
বিশ্বের প্রায় সাড়ে তিন শত কোটি মানুষ জীবনধারণের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধানের ওপর নির্ভরশীল। এত বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনধারণে প্রভাব রাখা শস্যধানের জিনগত পরিবর্তন আনার মাধ্যমে সাগরে ধান উৎপাদনের মতো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন উন্নত বিশ্বের প্রতিথযশা ধান বিজ্ঞানীরা। কেননা, জিন এডিটিং প্রযুক্তির মাধ্যমে তারা ধানে এমন জিনের (বংশগতির একক) উপস্থিতি ইতিমধ্যেই শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন, যেটি উচ্চমাত্রায় লবণাক্ত সহনশীল। আমাদের দেশীয় গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এখন পর্যন্ত পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় ধানে বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ত সহনশীল ১১টি লবণসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন।
বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা আনুমানিক ৭৭০ কোটি, ২০৫০ সাল নাগাদ এর সঙ্গে যোগ হবে আরও প্রায় ২০০ কোটি নতুন মুখ। এতো মানুষের খাবার জোগাড় করা নিঃসন্দেহে বিরাট চ্যালেঞ্জ। তদুপরি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব তো রয়েছেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের মাধ্যমে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার নতুন উপায় খুঁজছেন ইরির মতো বিশ্বের খ্যাতনামা কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
সনাতন কৃষিতে সার, সেচ, কীটনাশক, শ্রমিকসহ নানাবিধ উপকরণের প্রয়োজন পড়ে। কৃষিখাতে বেশিরভাগ পানিই ব্যবহৃত হয় সেচের কাজে। ধানসহ কিছু কিছু ফসলের পানির চাহিদা অন্য ফসলের তুলনায় অনেক বেশি। এটি বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত পানি পছন্দকারী ফসলও বটে। বিজ্ঞানীদের মতে এক কেজি ধান উৎপাদনে খরচ হয় ১২০০-১৫০০ লিটার পানি।
বিশ্বের একশটিরও বেশি দেশে ধান চাষ হয়, যা মানুষের জীবনধারণে প্রত্যক্ষ প্রভাব রাখে। সারা পৃথিবীতে বছরে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদিত হয়, যার ৯০ শতাংশই হয় এশিয়ায়। বিশ্বের সাড়ে তিনশ কোটির বেশি মানুষ প্রতিদিন ক্ষুধা নিবারণের জন্য ভাতের ওপর নির্ভরশীল। জনজীবনে ধানের বা চালের এমন বিপুল গুরুত্বের কারণে বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল ধানের জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ফলনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা। যদিও ধানের জিনগত পরিবর্তনের প্রচেষ্টা নতুন কিছু নয়।
বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান ব্যাপক ভিটামিন ‘এ’ ঘাটতি পূরণে ১৯৯৯ সালে সর্বপ্রথম ধানের জিনগত পরিবর্তন করে বিটা-ক্যারোটিন-এর সংযোজনের জন্য গোল্ডেন রাইস প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ভাত যেখানে প্রধান খাদ্যশস্য সেখানে অন্ধত্ব মোচনে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইস প্রচলনে গবেষণা শুরু হয়। যেটি এখনও অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। জিনগত পরিবর্তনের অন্যান্য গবেষণা প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে- ধানের সালোকসংশ্লেষণ সক্ষমতা বৃদ্ধি, বন্যা ও খরা সহনশীল ধানের জাত এবং ধান গাছের মিথেন নিঃসরণ কমানোর জন্য জিনগত পরিবর্তনের কৌশল অবলম্বন। গোল্ডেন রাইসের বিটা-ক্যারোটিন মানবদেহের প্রয়োজন অনুসারে ভিটামিন ‘এ’-তে রূপান্তরিত হয়। এটি উদ্ভাবনের জন্য বিজ্ঞানীরা রাইস জিনোমো ভুট্টা ও ব্যাকটেরিয়া থেকে দুটি জিন সংযোজন করেন। কৃত্রিম জিন সংযোজন ও রূপান্তরের কারণে এই প্রক্রিয়াটি কিছুটা বিতর্কিত। যদিও এই ধানের উদ্ভাবক ড. পিটার বেয়ার ও ইঙ্গো পট্রিকাস মনে করেন ভাত যাদের প্রধান খাদ্য এমন কোটি কোটি মানুষের প্রাত্যহিক ভিটামিন-এ’র চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম।
জিএমও বিতর্কের কারণে অ্যাগ্রিসিয়া ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। তারা সমুদ্রের পানিতে উৎপাদনের জন্য এমন ধানের জাত নির্বাচন করবে যেগুলোতে ইতিমধ্যে লবণাক্ত সহনশীল জিনের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা গেছে। লবণাক্ত সহনশীল এসব ধানের জাত সমুদ্রের পানিতে মাটি, সার ও মিষ্টি পানি ছাড়াই চাষ করা যাবে। অন্য ফসল বা প্রাণী থেকে জিন স্থানান্তর না করেই তারা ধানে এমন জিনগুচ্ছ শনাক্ত করেছেন, যেগুলো লবণাক্ত এড়িয়ে ডিএনএকে সুরক্ষা প্রদান ও কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে সক্ষম।
অ্যাগ্রিসিয়ার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী লুকি ইয়াং বলেন, এই ধানে লবণাক্ত সহনশীল জিনগুচ্ছ একটি নেটওয়ার্কের মতো কাজ করবে, যেমনটি প্রাকৃতিকভাবেও ঘটে। প্রকৃতি প্রদত্ত লবণাক্ত প্রতিরোধের গাছের নির্দিষ্ট শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াটিকে আমরা শুধু উন্নত করার চেষ্টা করছি, যাতে ধান গাছ সমুদ্রের লোনা পরিবেশে সহজে বেড়ে উঠতে এবং টিকে থাকতে পারে। এটি ক্রমাগত পুনঃপ্রজননের মাধ্যমেও করা যায়, কিন্তু দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজটি করার জন্য আমরা জিন এডিটিং কৌশল অবলম্বন করব।
লুকি ইয়াং-এর মতে, এ কাজের প্রথম পদক্ষেপটি ছিল লবণ প্রতিরোধী ফসলের একটি পোর্টফোলিও তৈরি করা, যা অবশেষে বিশ্বজুড়ে সমুদ্রের লোনা পানিতে চাষাবাদ করা যাবে। ধানের পরীক্ষামূলক ভাসমান সমুদ্রখামার স্থাপনের জন্য অ্যাগ্রিসিয়া ইতিমধ্যে বড় ধান উৎপাদন ও ব্যবহারকারী দেশ যেমন— নাইজেরিয়া, চীন, ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশসহ বিনিয়োগকারী দেশ নিউজিল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং চিলির সঙ্গে আলোচনা করেছে।
এই বছরের শেষ নাগাদ তারা সমুদ্রে তাদের প্রথম পাইলট খামার স্থাপনের পরিকল্পনা করছে, তবে তারা ২০২১ সালের শেষ নাগাদ একাধিক বৃহত্তর পাইলট খামার স্থাপনের প্রত্যাশা করছে। ধান উৎপাদন দেশগুলোর জন্য খাদ্য জোগানের পাশাপাশি এই সমুদ্র খামারগুলো নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট মৃত অঞ্চল ও ছত্রাক বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণেও ব্যবহার করা যাবে। এই খামারগুলো সমুদ্রের পানির ছাঁকনি (ফিল্টার) হিসেবে কাজ করবে এবং অতিরিক্ত পুষ্টি উপাদান যা কৃষিক্ষেত্র থেকে জলাধারে প্রবাহিত হয়, সেগুলোকে ভেঙে ফেলে এর বিরূপ প্রভাব প্রশমন করবে। এই ধরনের খামারে লবণাক্ত সহনশীল ফসল সরাসরি বপন কিংবা রোপণ করা যাবে। জাপানের মতো দেশ যেখানে উপকূলীয় এলাকার মাটি নিয়মিত সুনামির লোনা পানিতে প্লাবিত হয়, সেখানে অলোনা অঞ্চল থেকে মাটি এনে চাষাবাদের ব্যয় হ্রাস ও শ্রম লাঘব করবে এই সমুদ্র খামারগুলো।
এ উচ্চাভিলাষী গবেষণার জন্য ইনডিবায়ো নামক বিজ্ঞান-প্রণোদনা প্রদানকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রাথমিক অনুদান পেয়েছে অ্যাগ্রিসিয়া। কানাডার অন্টারিওতে এ সংক্রান্ত গবেষণাগার স্থাপনের কাজ চলছে। দশ লাখ ডলারের অনুদান সংগ্রহের মাধ্যমে আরও অতিরিক্ত উদ্ভিদবিজ্ঞানী নিয়োগ এবং তাদের লবণসহিষ্ণু ফসলের পোর্টফোলিও আরও সম্প্রসারণের মাধ্যমে ভুট্টা, গম, বার্লি, সয়াবিন, মুগডাল, পালংশাক এবং আরও অনেক ফসল অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করছে।
লেখক: ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি। ই-মেইল [email protected]
এমএমজে